লোকার্নো চুক্তি কি
Contents
লোকার্নো চুক্তি কি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরােপ তথা বিশ্ব জুড়ে শান্তি রক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি অত্যন্ত বড়াে হয়ে ওঠে । ফ্রান্স নিরাপত্তার লক্ষ্যে চেকোশ্লোভাকিয়া , যুগােশ্লাভিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করলেও চুক্তিগুলির কার্যকারিতা ও উপযােগিতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে । জেনেভা প্রােটোকলের ( ১৯২৪ খ্রি. ) ব্যর্থতার পর ফ্রান্স ও জার্মানি উভয়েই উভয়ের শত্রুতায় আতঙ্কিত থাকায় এক মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে সচেষ্ট হয় । এই পরিস্থিতিতে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্ট্রেসম্যান এই চুক্তির প্রস্তাব পাঠালে ফ্রান্স তাতে সাড়া দেয় । ফলে যুদ্ধের পরিবেশ মুক্ত হয়ে শান্তির পরিবেশ গড়ে ওঠে । তাই ব্রিটিশ মন্ত্রী চেম্বারলিন বলেছেন — যুদ্ধ ও শান্তির বছরগুলির মধ্যে লােকার্নো ছিল প্রকৃত বিভাজন রেখা । ( ‘ Locarno was the real dividing line between the years of war and the years of peace ‘ ) ।
লোকার্নো চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ
জার্মানির চুক্তি প্রস্তাবে রাজি হলেও ফ্রান্স চেয়েছিল যে এই মৈত্রী বিষয়ক আলােচনাতে পােল্যান্ড , বেলজিয়াম , চেকোশ্লোভাকিয়া ও ইতালি অংশ গ্রহণ করুক । ফ্রান্সের ইচ্ছানুসারে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী লােকার্নোতে ( ১৯২৫ খ্রি . অক্টোবর ) পােল্যান্ড , বেলজিয়াম , চেকোশ্লোভাকিয়া , ব্রিটেন , ইতালি , ফ্রান্স ও জার্মানির প্রতিনিধিবর্গ মিলিত হন এক বন্ধুত্ব পূর্ণ পরিবেশে লােকার্নোতে সাতটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
লোকার্নো চুক্তির সাতটি চুক্তি
1. জার্মানি , ফ্রান্স , ইতালি , বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের মধ্যে পরস্পর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।
2. জার্মানি আলাদা আলাদা ভাবে ফ্রান্স , পােল্যান্ড , বেলজিয়াম এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে চারটি সালিশি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ।
3. ফ্রান্স , পােল্যান্ডের সঙ্গে একটি ও চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্গে একটি পারস্পরিক প্রতিশ্রুতিমূলক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় । এই সাতটি চুক্তি মিলিত ভাবে লােকার্নো চুক্তিরূপে পরিচিত ।
লোকার্নো চুক্তির শর্ত
লােকার্নো চুক্তির উল্লেখযােগ্য কয়েকটি শর্ত ছিল—
1. জার্মানি , ফ্রান্স ও বেলজিয়াম জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ বাদে অন্য কোনাে যুদ্ধে একে অপরের বিরুদ্ধে মুখােমুখি হবে না ।
2. জার্মানি ও পােল্যান্ড এবং জার্মানি ও চেকোশ্লোভাকিয়ার মধ্যে কোনাে বিবাদ বাঁধলে আন্তর্জাতিক সালিশের মাধ্যমে তার মীমাংসা করা হবে ।
3. চুক্তি স্বাক্ষরের পর জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদ পাবে এবং জাতিসংঘের কাউন্সিলে এক স্থায়ী পদ লাভ করবে ।
4. প্ররােচনাহীন আক্রমণের ক্ষেত্রে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সকল রাষ্ট্রই আক্রান্ত রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াবে ।
5. চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অধিকার নিয়ে কোনাে বিরােধ বাঁধলে তার নিস্পত্তির লক্ষ্যে স্থায়ী সালিশি কমিশন বা জাতিসংঘের কাউন্সিল উদ্যোগ নেবে ।
6. রাইন অঞ্চলে সেনা সমাবেশ থেকে জার্মানি বিরত থাকবে ।
লোকার্নো চুক্তির গুরুত্ব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে লােকার্নো চুক্তি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । এই চুক্তির মাধ্যমেই ー
জার্মানির মর্যাদা বৃদ্ধি :
যুদ্ধে পরাজিত জার্মানি বিজয়ী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সমান মর্যাদা লাভ করে । বিজয়ী ও বিজিতের মধ্যে ভেদ রেখার বিলুপ্তি ঘটে ।
ফ্রান্স – জার্মানি সম্পর্কের উন্নতি :
এতদিন ধরে ফ্রান্সের যে জার্মান ভীতি ছিল এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় । ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে বিদ্বেষমূলক মনােভাব ও তিক্ততা হ্রাস পায় ।
স্বেচ্ছা চুক্তি :
ভার্সাই চুক্তির মতাে জোর করে এই সন্ধি জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি । জার্মানি স্বেচ্ছায় এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল । তাই এটি লঙ্ঘিত হওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা ছিল না ।
ইঙ্গ – ফরাসি সম্পর্কের উন্নতি :
লােকার্নো চুক্তির আর একটি অন্যতম সুফল ছিল ফ্রান্সের পূর্বেকার মৈত্রী জোট অক্ষুন্ন রাখা এবং ইঙ্গ – ফরাসি সম্পর্কের উন্নতি ঘটানাে ।
শান্তি প্রতিষ্ঠা :
ইউরােপ মহাদেশে যুদ্ধের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লােকার্নো চুক্তি অনেকাংশে সফল হয়েছিল । তাই লােকার্নো চুক্তির অন্যতম গুরুত্ব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক এ. জে. পি. টেলর বলেছেন – এই চুক্তি সমূহ ইউরােপে শান্তি ও আশার যুগের সঞ্চার করে ( ‘ Locarno gave to Europe a period of peace and hope ‘ ) ।