ভার্সাই সন্ধির সমালোচনা
Contents
ভার্সাই সন্ধির সমালোচনা
ঐতিহাসিক , গবেষক ও সমালােচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভার্সাই সন্ধিকে সমালােচনা করেছেন । এই বিতর্কিত সন্ধিকে কেউ ‘ মৃত্যু পরিকল্পনা ও দাসত্বের শৃঙ্খল ’ , কেউ ‘ একতরফা ও জবরদস্তিমূলক সন্ধি , কেউ ‘ ম্যাকিয়াভেলির সন্ধি ’ , কেউ ‘ অনুদার সন্ধি ’ , কেউ বা ‘ নীতি ও আদর্শ বর্জিত সন্ধি ’ বলে উল্লেখ করেছেন ।
জবরদস্তিমূলক সন্ধি
ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির ওপর যেভাবে জোরজবরদস্তি করে ক্ষতিপূরণের বােঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ও ভৌমিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল , বিশ্ব ইতিহাসে এরূপ নমুনা আর কোনাে সন্ধিতে নেই । ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানি তার পঁচিশ হাজার বর্গ মাইল এলাকা , শতকরা পনেরাে ভাগ কৃষি জমি , শতকরা বারাে ভাগ শিল্পাঞ্চল , এসবের পাশাপাশি সত্তর লক্ষ বাসিন্দাকেও হারিয়েছিল । তাই ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেছেন , “ জার্মানির কাছ থেকে আদায়িকৃত এই চুক্তির প্রতি তার কোনাে নৈতিক দায়বদ্ধতা ছিল না ” ( The signature extorted from Germany in these conditions was not morally binding of her . ) ।
অমানবিক সন্ধি
ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি এতটাই কঠোর ছিল যে এই সন্ধি জার্মানদের মনে এক সুদূর প্রসারী মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল । ঐতিহাসিক ল্যাসিং এর মতে জার্মানির ওপর প্রতিশােধের লক্ষ্যে মিত্রশক্তি এই অমানবিক সন্ধির শর্তগুলি চাপিয়ে দিয়েছিল । এই চুক্তিকে অমানবিক অ্যাখ্যা দিয়ে ঐতিহাসিক এইচ. এ. এল. ফিশার বলেছেন 一 তারা ( মিত্রশক্তি ) যে শান্তি চুক্তি তৈরি করেছিল তাতে কোনাে শান্তি ছিল না । মানবিক দিক থেকে তা ছিল ব্যর্থ ( ‘ They had made a peace which was no peace . Human nature it was widely felt had failed ‘ ) ।
অনুদার সন্ধি
যুদ্ধ সৃষ্টির অপরাধে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে মিত্রপক্ষ জার্মানির প্রতি যে চরম অনুদারতা দেখিয়েছিল , তা ছিল অবশ্যই নিন্দনীয় । জার্মানির ভূখণ্ড অধিগ্রহণ করা থেকে শুরু করে , উপনিবেশ দখল , সম্পদ অধিকার ইত্যাদির দরুন এই সন্ধি অনুদার সন্ধি হয়ে ওঠে । এই চরম অনুদারতার বিরুদ্ধে সমগ্র জার্মানি জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । জার্মানরা এর যােগ্য জবাব দেওয়ার জন্য সুযােগের অপেক্ষায় থাকে । জার্মানদের এই প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে ফরাসি সেনাধ্যক্ষ বলেছেন ভার্সাই সন্ধি আসলে জার্মানিকে রণসাজে সজ্জিত হয়ে উঠতে কুড়ি বছরের যুদ্ধ বিরতি ছিল মাত্র । ঐতিহাসিক লিপসন বলেছেন , “ মিত্রশক্তি বর্গ যদি জার্মানির প্রতি কিছুটা নমনীয় ও সদয় আচরণ করত , তাহলে জার্মানি ভালােভাবেই এই সন্ধি মেনে নিত । ”
জাতীয়তাবাদ বিরােধী সন্ধি
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ঘােষিত চোদ্দো দফা শর্তে যে জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়েছিল , ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি । জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দিয়ে একদিকে যেমন প্যারিস শান্তি সম্মেলনের নেতৃমণ্ডলী ফ্রান্সকে আলসাস – লােরেন , পােল্যান্ডকে পােজেন ও পশ্চিম প্রাশিয়া , ডেনমার্ককে স্লেজউইগ ছেড়ে দেন , অন্যদিকে অস্ট্রিয়া , পােল্যান্ড , বেলজিয়াম , চেকোশ্লাভাকিয়ায় বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক জার্মানদের প্রতি বিরূপ মনােভাব দেখান । এ ছাড়াও পােল্যান্ডকে জার্মানির ভিতর দিয়ে ‘ পােলিশ করিডর ’ নামক সংযােগ পথ উপহার দেওয়ার ফলে , জার্মানি দ্বিখণ্ডিত হয় । জার্মানির ডানজিগ বন্দরকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয় এবং সার অঞ্চলকে জার্মানি থেকে পৃথক করা হয় । এই ধরনের জাতীয়তাবাদ বিরােধী কার্যকলাপ জার্মান জাতীয়তাবাদকে আহত করে ।
অনমনীয় সন্ধি
ভার্সাই সন্ধি ছিল এক অনমনীয় সন্ধি । ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন শর্তগুলিতে যে অনমনীয়তা দেখানাে হয়েছিল তারই প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকা রচিত হয় । ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেছেন — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ লুকিয়েছিল ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই । ঐতিহাসিক ই. লিপসন বলেছেন ー মিত্রপক্ষ একটু নমনীয় হলে জার্মানি আক্রমণকারী হত না ।
অর্থ আদায়কারী সন্ধি
ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি জার্মানির ওপর আরােপ করে যেভাবে অর্থ আদায় করা হয়েছিল , তাতে একে বহু ঐতিহাসিক অর্থ আদায়কারী সন্ধি বলে উল্লেখ করেছেন । মিত্রশক্তিবর্গের পক্ষে ক্ষতিপূরণ কমিশন জার্মানিকে সাঁইত্রিশ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করার কথা বলেন । জার্মানিকে আর্থিক দিক থেকে শেষ করে দিয়ে তার কাছে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার সাহায্য চাওয়া ছিল দুরাশা । এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রাইকার বলেছেন রাজহংসীকে উপােসি রেখে কেউ তার কাছে সােনার ডিমের প্রত্যাশা করতে পারে না ( ‘ One cannot starve a goose and expect it to lay golden eggs ‘ ) । উইনস্টন চার্চিল ভার্সাই সন্ধির শর্তাবলিকে এক ‘ বিরাট অর্থহীন ও অবাস্তব ‘ বলে মনে করেছেন ।