ইতিহাস

প্যারিস চুক্তি / কেলগ-ব্রিয়া চুক্তি কি

Contents

প্যারিস চুক্তি / কেলগ-ব্রিয়া চুক্তি কি

লােকার্নো চুক্তির সৌহার্দ্য ইউরােপীয় শক্তিবর্গের মধ্যে যে আস্থার মনােভাব জাগিয়ে তুলেছিল , নানা কারণে তা হ্রাস পেতে থাকলে উদবিগ্ন ফ্রান্স আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে আবার ব্যগ্র হয়ে ওঠে । এই অবস্থায় ফ্রান্স আমেরিকাকে পারস্পরিক যুদ্ধ বিরােধী প্রস্তাব নিয়ে আলােচনার জন্য আমন্ত্রণ জানালে মার্কিন বিদেশ সচিব ফ্রাঙ্ক কেলগ তা গ্রহণ করেন । ফরাসি বিদেশমন্ত্রী অ্যারিস্টাইড ব্রিঁয়াকে তিনি জানান যে , অন্যান্য শক্তিকে নিয়ে একটি যুদ্ধ বিরতি চুক্তি রচনা করতে তিনি রাজি আছেন । এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট প্যারিস শহরে ১৫ টি দেশের প্রতিনিধিরা একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । এই চুক্তিটিই কেলগ-ব্রিঁয়া চুক্তি বা প্যারিস চুক্তি নামে খ্যাত । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৬২ টি ( মতান্তরে ৬৫ ) রাষ্ট্র এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় । 

প্যারিস চুক্তির শর্তাবলী

এই চুক্তিপত্রে একটি প্রস্তাবনা ও তিনটি ধারা ছিল । পৃথিবীতে শান্তি ও মৈত্রীর ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের কথাই এর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে । আর এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দেশ এই শর্তে অঙ্গীকার করে যে — 

1. জাতীয় নীতি হিসেবে যুদ্ধকে নিন্দা ও বর্জন করা হবে ; 

2. শান্তিপূর্ণ পথে সকল বিবাদ মীমাংসার জন্য সালিশি ও বােঝাপড়া নীতি মেনে চলা হবে এবং 

3. অন্যান্য রাষ্ট্রের সদস্যপদ গ্রহণের জন্য চুক্তিপত্র উন্মুক্ত রাখা হবে । 

প্যারিস চুক্তির ত্রুটি

কেলগ-ব্রিঁয়া বা প্যারিস চুক্তি ( ১৯২৮ খ্রি. ) সম্পূর্ণরূপে ত্রুটি মুক্ত ছিল না — 

1. এই চুক্তির দ্বারা আত্মরক্ষার জন্য বা পূর্বেকার চুক্তির শর্তগুলি রক্ষার জন্য বা লােকার্নো চুক্তির শর্ত ভাঙার অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমােদন দেওয়া হয় । 

2. এই চুক্তির শর্তগুলি কীভাবে সফলতার সঙ্গে রূপায়ণ করা হবে সে বিষয়ে কোনাে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না । 

3. চুক্তি অমান্যকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনাে নির্দেশ ছিল না এই চুক্তিতে । 

4. এই চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধকে বেআইনি ঘােষণা করা হলেও অঘােষিত যুদ্ধ বা আক্রমণাত্মক যুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাব ছিল এবং এই রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে কীরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে কোনাে উল্লেখ ছিল না ।

প্যারিস চুক্তির গুরুত্ব

শান্তি প্রতিষ্ঠায় :

প্যারিস চুক্তি ( ১৯২৮ খ্রি. ) ইউরােপ তথা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল । ইতিপূর্বে বিশ্বে এতগুলি রাষ্ট্র কোনাে চুক্তির জন্য কখনও ঐক্যবদ্ধ হয়নি । 

নিরাপত্তা রক্ষায় : 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় আমেরিকা ও রাশিয়া এই প্রথম পরস্পরের সংস্পর্শে এসে চুক্তিবদ্ধ হয় । এইভাবে বিশ্বের নিরাপত্তা ও বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায় । 

মিত্রতা গঠনে :

এই চুক্তির অনুকরণেই পরবর্তীকালে বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে নানা মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে থাকে । প্যারিস চুক্তির গুরুত্ব ও কৃতিত্ব এখানেই । 

মূল্যায়ন 

প্যারিস চুক্তিকে আপাত দৃষ্টিতে এক নৈতিক ঘােষণা বলে মনে হলেও এটি ছিল আসলে এক রাজনৈতিক চুক্তি । এই চুক্তিতে যুদ্ধকে বর্জন করার কথা বলা হলেও , আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধকে এখানে বর্জন করা হয়নি । ফলে আত্মরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে যে – কোনাে দেশ সংঘর্ষের পথে পা বাড়াতে পারত । সর্বোপরি , যুদ্ধের সম্ভাবনাকে নির্মূল করতে নিরস্ত্রীকরণ যে একটি অমােঘ অস্ত্র — এই চুক্তির উদ্যোক্তারা তা অবজ্ঞা করেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!