জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য / প্রসার / ব্যর্থতা
Contents
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য / প্রসার / ব্যর্থতা
স্বদেশি আন্দোলন থেকে ছাত্রদের দূরে সরিয়ে রেখে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে সরকার একটার পর একটা আইন জারি করতে থাকে । কার্লাইল সার্কুলার ( ১০ অক্টোবর , ১৯০৫ খ্রি. ) , লিয়ন সার্কুলার ( ১৬ অক্টোবর , ১৯০৫ খ্রি. ) , পেডলার সার্কুলার ( ২১ অক্টোবর , ১৯০৫ খ্রি. ) ইত্যাদি কুখ্যাত ফতােয়ায় স্কুল কলেজের ছাত্রদের রাজনৈতিক আন্দোলন বা সভা সমিতিতে যােগদান , এমনকি প্রকাশ্যে ‘ বন্দেমাতরম্ ’ ধ্বনি উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয় । প্রত্যুত্তরে ২৪ অক্টোবর ( ১৯০৫ খ্রি. ) এক জনসভায় বিপিনচন্দ্র পাল ওইসব ফতােয়ার তীব্র সমালােচনা করেন । এবং ছাত্রদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে স্বতন্ত্রভাবে সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে দেশে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন ।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য
বিদেশি শিক্ষা বর্জন করে ছাত্রদের দেশীয় শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা ছিল জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য । এই লক্ষ্য পূরণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক স্বদেশি উদ্যোগে বিদ্যালয় গড়ে ওঠে ।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রসার
শিক্ষালয় স্থাপন :
পূর্ববঙ্গের রংপুরে ৮ ই নভেম্বর ( ১৯০৫ খ্রি. ) কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ও ব্রজসুন্দর রায়ের নেতৃত্বে প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় । নভেম্বর ( ১৯০৫ খ্রি. ) মাসে কলকাতায় ছাত্রদের সরকার বিরােধী আন্দোলনে উৎসাহ দানের জন্য শচীন্দ্র বসুর সম্পাদনায় প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যান্টি – সার্কুলার সােসাইটি । সরকার বিরােধী কার্য কলাপের জন্য যে সব ছাত্ররা বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করাই ছিল এই সােসাইটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ।
জাতীয় শিক্ষায় অর্থ সাহায্য :
সুবােধচন্দ্র মল্লিক , জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরী , মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী , স্যার তারকনাথ পালিত , ড. রাসবিহারী ঘােষ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রচুর অর্থ সাহায্য দানের কথা ঘােষণা করেন । পাশাপাশি এই ব্যবস্থাকে সার্থক করে তুলতে এগিয়ে আসেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ , স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ মনীষী ।
বাংলায় জাতীয় শিক্ষার প্রসার :
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে এক সভায় ৯২ জন সদস্য নিয়ে কলকাতায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ( ১৯০৬ খ্রি. ১১ মার্চ ) গঠিত হয় । ওই পরিষদের পরিচালনায় বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষালয় স্থাপিত হলে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে । অরবিন্দ ঘােষকে অধ্যক্ষ করে একটি জাতীয় মহাবিদ্যালয় ( ১৯০৬ খ্রি. ১৪ আগস্ট ) প্রতিষ্ঠিত হয় । ওই বছরই স্থাপিত হয় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট ( ১৯০৬ খ্রি. ২৪ জুলাই ) । পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় শান্তিনিকেতন – শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা ছিল স্বদেশি যুগে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের এক সফল প্রয়াস ।
জাতীয় শিক্ষা অন্যান্য প্রদেশ :
উল্লেখ্য যে , জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলার বাইরেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে । বােম্বাই , মাদ্রাজ , উত্তরপ্রদেশ , বেরার প্রভৃতি অঞ্চলে বহু জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । মুসলিপত্তমে একটি জাতীয় মহাবিদ্যালয় স্থাপিত হয় । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশে একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয় ।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের ব্যর্থতা
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই জাতীয় শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা স্তিমিত হয়ে যায় । এই ব্যর্থতার পিছনে তিনটি বিশেষ কারণ কাজ করেছিল ।
- রাজনৈতিক স্বার্থ স্বদেশি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠায় জাতীয় শিক্ষাবিস্তারের দিকে আগ্রহ কমে যায় ।
2. ওইসব বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রদের সরকারি চাকরির কোনাে আশা না থাকায় মধ্যবিত্ত বাঙালি এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে দূরে সরে যায় ।
3. সরকারের বিরােধিতা , সেই সঙ্গে অর্থসংকট এই শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ।