অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি (Subsidiary Alliance)
Contents
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি (Subsidiary Alliance)
লর্ড ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দেশীয় রাজ্যগুলিকে বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষার অজুহাতে যে নীতির প্রয়ােগ ঘটিয়ে কোম্পানির অধীনতা গ্রহণের জন্য বাধ্য করেন , তার নাম অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ( Policy of Subsidiary Alliance ) । এই নীতিটি প্রসঙ্গে লর্ড ওয়েলেসলি নিজেই বলেছেন — দেওয়ানি লাভের পর অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ছিল সবথেকে স্বতন্ত্র ও উপযােগী ব্যবস্থা (‘ … the most solitary and useful measure after the diwani ’) ।

অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি এর উদ্ভাবক
অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতির উদ্ভাবক লর্ড ওয়েলেসলি নন । তার অনেক আগেই লর্ড ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংস প্রায় এই ধরনেরই নীতির প্রচলন ঘটিয়ে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন । যদিও এই ধরনের নীতি সেসময়কার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অনুমােদন নিয়ে প্রয়ােগ হয়নি।
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির শর্ত
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির উল্লেখযােগ্য শর্ত গুলি হল —
স্বাক্ষরকারী দেশীয় রাজ্যগুলি কোম্পানির অনুমতি না নিয়ে অন্য কোনাে রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি বা মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে না । স্বাক্ষরকারী দেশীয় রাজ্যগুলিকে সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে এক ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বা প্রতিনিধিসহ একদল ব্রিটিশ সৈন্য রাখতে হবে । স্বাক্ষরকারী রাজ্যগুলিকে যদি তৃতীয় কোনাে পক্ষ আক্রমণ করে , তাহলে তাকে রক্ষা করবে কোম্পানি । সেনাবাহিনীর খরচ চালানাের জন্য বৃহৎ রাজ্যগুলি নিজেদের রাজ্যের একাংশ কোম্পানিকে ছেড়ে দেবে । ছােটো রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে নগদ টাকা কররুপে কোম্পানিকে দিতে বাধ্য থাকবে। স্বাক্ষরকারী রাজ্যগুলি কোম্পানির অনুমতি ছাড়া অন্য কোনাে ইউরােপীয় কোম্পানির ব্যক্তিকে নিজের সেনাবাহিনীতে বা সরকারি চাকরির পদে নিতে পারবে না ।
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রয়োগ
লর্ড ওয়েলেসলি এই নীতির দ্বারা বেশ কিছু দেশীয় রাজ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । এরকম কয়েকটি রাজ্য ছিল তাঞ্জোর ( ১৭৯৯ খ্রি. ২৫ অক্টোবর ) , সুরাট ( ১৮০০ খ্রি. মার্চ ) , হায়দ্রাবাদের নিজাম ( ১৮০০ খ্রি. অক্টোবর ) , কর্নাটক ( ১৮০১ খ্রি. ২৫ জুলাই ) । এ ছাড়াও তিনি একে একে অযােধ্যার নবাব , পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাওকে এই চুক্তিতে আবদ্ধ করেন । মালব , উদয়পুর , যােধপুর , জয়পুর , গায়কোয়াড় , বুন্দেলখণ্ড প্রভৃতি রাজ্যেও কোম্পানি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রয়ােগ করে ।
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির গুরুত্ব
ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
কোম্পানি কর্তৃক নিয়ােজিত ব্রিটিশ রেসিডেন্ট দেশীয় রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীণ শাসননীতিতে হস্তক্ষেপ করলে সেই রাজ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছােয় । দেশীয় রাজাদের অর্থে ইংরেজরা এক বিশাল সেনাবাহিনী মােতায়েন রাখার সুযােগ পেলে এদেশে কোম্পানির নিরাপত্তার জন্য সামরিক খরচ অনেকটাই কমে যায় । অধীনতামূলক মিত্ৰতা নীতিতে আবদ্ধ করে বহু দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক গড়ে উঠলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কোম্পানি তার ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটায় । ব্রিটিশ নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ায় দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের সেনাবাহিনী ভেঙে দেয় । দেশীয় রাজ্যগুলির সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে ব্রিটিশ শর্ত অমান্যের অজুহাত এনে যে – কোনাে সময় দেশীয় ও মিত্র রাজ্যগুলিকে গ্রাস করার পথ খােলা রাখে । এই নীতিতে আবদ্ধ হয়ে দেশীয় রাজ্যগুলি কার্যত নিজেদের স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দেয় এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তােলার অধিকার হারায় ।
উপসংহার
লর্ড ওয়েলেসলি অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির ফাঁদে ফেলে বহু দেশীয় রাজ্যকে গ্রাস করে । ভারতবর্ষের এক বিশাল অংশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । ঐতিহাসিক ডডওয়েলের মতে – ক্লাইভ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপন করেন , ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে ঝড়ঝাপটা থেকে রক্ষা করেন এবং ওয়েলেসলি তাকে বৃহৎ রাজশক্তিতে পরিণত করেন ।