ইতিহাস

সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে লালা লাজপত রায়ের ভূমিকা

Contents

সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে লালা লাজপত রায়ের ভূমিকা

ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভব বা চরমপন্থী মতবাদের বিকাশে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন লালা লাজপত রায় ( ১৮৬৫ – ১৯২৮ খ্রি. ) । আর্য সমাজের প্রভাবে একজন শুদ্ধি আন্দোলনের নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে লালবালপাল যুগের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন লালা লাজপত রায় । তিনি কংগ্রেসের প্রথম যুগের কার্যকলাপের কঠোর সমালােচক ছিলেন । তিনি বলেন — “ পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ জাতীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতার তুলনায় তুচ্ছ ” ।

images 1 1
লালা লাজপত রায়

লালা লাজপত রায়ের বিপ্লবী মতাদর্শ

পাঞ্জাবে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের মধ্যে লালা লাজপত রায় ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব । অল্প বয়সেই তিনি স্বামী দয়ানন্দের সংস্পর্শে এসে আর্য সমাজে যােগদান করেন । ম্যাৎসিনি , গ্যারিবল্ডি ও ইউরােপের বিভিন্ন গুপ্ত সমিতির কার্যাবলি ও ইতিহাস তাঁকে সংগ্রামের পথে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহিত করে । ভারতবর্ষের পুনরুজ্জীবন ও ব্রিটিশ শাসন মুক্ত স্বরাজ অর্জন ছিল তাঁর জীবনাদর্শ । স্বাধীনতাকেই তিনি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে মানতেন । দেশাত্মবােধ এবং দেশের জন্য আত্মত্যাগ তাঁর কাছে ছিল পরম ধর্ম । তিনি দেশবাসীর মনে আত্মশক্তি জোগানাের জন্য আত্মত্যাগের আদর্শ প্রচার করেন ।

লালা লাজপত রায়ের প্রথম জীবন

পাঞ্জাব কেশরি লালা লাজপত রায় পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার জারগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ( ১৮৬৫ খ্রি. ) । পিতা মুন্সী রাধাকিষাণ রায় ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক । আইন পরীক্ষায় পাস করে তিনি ওকালতি শুরু করেন এবং প্রচুর অর্থ ও সুনাম অর্জন করেন । ওকালতির পাশাপাশি তিনি দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজের সঙ্গেও যুক্ত হন । এসময় তিনি আর্যসমাজের নেতা গুরুদত্ত , লালা হংসরাজের সঙ্গে পরিচিত হন এবং শুদ্ধি আন্দোলনের এক প্রবক্তারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ।

লালা লাজপত রায়ের কংগ্রেসে যোগদান

জাতীয় কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনে ( ১৮৮৮ খ্রি. ) তিনি যােগ দেন । কিন্তু এলাহাবাদ অধিবেশনে নরমপন্থী নেতাদের আবেদন – নিবেদন নীতি তাঁর কাছে ভিক্ষা বৃত্তিই মনে হয় । অচিরেই তিনি কংগ্রেসের এক চরমপন্থী নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন । তিলক ও বিপিনচন্দ্রের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠেন তিনি । তাই লাজপত রায় জাতীয় কংগ্রেসের গৃহীত সকল নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাননি । এমনকি কংগ্রেসের সকল কর্মসূচির প্রতিও তাঁর আস্থা ছিল না ।

সংগ্রামশীল নীতির প্রবক্তা

কার্জনের স্বৈরাচারী শাসন তাঁকে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তায় পরিণত করে ( ১৯০৫ খ্রি. ) । তিলকের মতাে তিনিও কংগ্রেসের নীতির তীব্র সমালােচনা করতে শুরু করেন । নরমপন্থা ত্যাগ করে গণ আন্দোলন , বয়কট , স্বদেশি ইত্যাদি সংগ্রামী নীতি গ্রহণ করতে তিনি ভারতবাসীকে আহ্বান জানান । বারাণসী কংগ্রেসে তিনিই প্রথম নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধের কর্মসূচি উত্থাপন করেন ।

পাঞ্জাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব

১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ভূমি বণ্টন ব্যবস্থা , সেচসেবিত এলাকায় কর বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পাঞ্জাবের কৃষিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক হিংসাশ্রয়ী গণ আন্দোলন দেখা দেয় । লালাজি ও প্রখ্যাত বিপ্লবী সর্দার অজিত সিং ওই বিক্ষোভের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন । সরকার বিনা বিচারে উভয়কেই মান্দালয়ে নির্বাসিত করে ।

আমেরিকায় প্রবাসী বিপ্লবী জীবন

নির্বাসনান্তে তিনি পাঞ্জাবে ফিরে আসেন । কিন্তু জাতীয়তাবাদের প্রসার রােধ করার জন্য পাঞ্জাবে সরকারি দমননীতি ও পুলিশি তৎপরতা তীব্র হয়ে উঠলে লালাজির কাছে তা অসহ্য হয়ে দাঁড়ায় । শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত ত্যাগ করে আমেরিকা চলে যান । সরকারও কালবিলম্ব না করে তাঁর ভারত প্রত্যাবর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে । এই সময়েই তিনি আমেরিকায় লালা হরদয়াল , মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং সেখানে হােমরুল লিগের একটা শাখা স্থাপন করেন । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ভারতে ফিরতে দেওয়া হয় ।

লালা লাজপত রায়ের অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান

দেশে ফেরার পর , ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন । এই সময় অসহযােগ আন্দোলনে যােগদান করায় তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় ( ১৯২১ খ্রি. ) । পরে অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হলে চিত্তরঞ্জন ও মােতিলাল প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ্য দলে তিনি যােগদান করেন ।

লালা লাজপত রায়ের সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান

ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে জন সাইমনের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের এক কমিশন গঠিত হয় । এই কমিশনে কোনাে ভারতীয় সদস্য না থাকায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয় । ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে লাহােরে সাইমন কমিশন বিরােধী এক বিক্ষোভ মিছিল পরিচালনাকালে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বেটনের নির্মম আঘাতে আহত লালাজি কয়েকদিন পরে মারা যান । তাঁর সংগ্রামী চরিত্রের জন্য লালাজি আজও পাঞ্জাব কেশরি নামে খ্যাত হয়ে আছেন ।

লালা লাজপত রায়ের জাতীয়তাবাদী লেখনী

শুধুমাত্র রাজনীতিবিদরূপে নন , একজন সুলেখকরূপেও লালা লাজপত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । উর্দু ভাষায় তিনি রচনা করেন ম্যাৎসিনি , গ্যারিবল্ডি ও শিবাজির জীবনকাহিনি । এ ছাড়াও তাঁর রচিত ‘ ইয়ং ইন্ডিয়া ’ , ‘ ইংল্যান্ডস ডেট টু ইন্ডিয়া ’ , ‘ দি পলিটিক্যাল ফিউচার অব ইন্ডিয়া ’ গ্রন্থগুলি জাতীয়তাবাদ প্রসারে সাহায্য করে । ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে লেখেন — ডাফরিনের মস্তিষ্ক থেকেই কংগ্রেসের জন্ম হয় ( ‘ Congress was a product of Dufferin’s brain ‘ ) ।

মূল্যায়ন

লালা লাজপত রায়ের কাছে জাতীয় সম্মান ও স্বাধীনতা ছিল সব কিছুর ওপরে । নেতা হিসেবে তাঁর সংগ্রামী মানসিকতার জন্য ‘ শের-ই-পাঞ্জাব ’ বা ‘ পাঞ্জাব কেশরি ’ বা পাঞ্জাবের সিংহ নামে তাঁকে অভিহিত করা হয় । তার রাজনৈতিক সততা , আত্মত্যাগ ও সর্বোপরি দেশমাতার পদতলে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে উৎসর্গ করার নিদর্শন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় তাকে চিরস্থায়ী আসন দান করেছে । লালা লাজপত রায় বলেন ভারতবাসীকে নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করেই স্বাধীন হতে হবে । তিনি বলেন – “ আমাদের প্রথম চাহিদা হল দেশপ্রেমকে ধর্মের মতাে গণ্য করা এবং তার জন্য বাঁচা বা মরার মতাে মানসিকতা জাগিয়ে তােলা ( ‘ Our first want is to raise our patriotism to the level of religion and to aspire to live or die for it ‘ ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!