সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ভূমিকা
Contents
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ভূমিকা
শ্ৰী অরবিন্দ ( ১৮৭২ – ১৯৫০ খ্রি. ) ছিলেন বিশ শতকে ভারতের উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বৈপ্লবিক সংগ্রামের অগ্নিময় প্রতিমূর্তি । বিপ্লবের পীঠস্থান বাংলায় চরমপন্থী মতবাদের ঋত্বিক ছিলেন অরবিন্দ ঘােষ । একজন চরমপন্থী নেতারূপে যেভাবে তিনি ভারতবর্ষের যুব সমাজকে বিপ্লবী মতাদর্শে দীক্ষিত করেছিলেন তার ফলেই ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে চরমপন্থী ভাবধারার প্রসার ঘটেছিল । লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলে শ্রী অরবিন্দ বলেন — “ মায়ের বুকের ওপর বসে যদি একটা রাক্ষস রক্তপান করতে উদ্যত হয় তখন ছেলে কি করবে ? নিশ্চিন্ত মনে খেতে বসবে ? স্ত্রী-সন্তানাদির সঙ্গে স্ফুর্তি করতে বসবে ? না মাকে উদ্ধার করতে ছুটে যাবে ? ”

শ্রী অরবিন্দ ঘোষের প্রথম জীবন
কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে অরবিন্দ জন্মগ্রহণ করেন ( ১৮৭২ খ্রি. ১৫ আগস্ট ) । পিতা কৃষ্ণধন ঘােষ , মাতা ছিলেন স্বর্ণলতা দেবী এবং মাতামহ ছিলেন স্বনামধন্য চিফ মেডিকেল অফিসার রাজনারায়ণ বসু । তাঁর শিক্ষাজীবন কাটে ইংল্যান্ডে । দার্জিলিং সেন্ট পলস স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করার পর মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁকে লন্ডনের সেন্ট পলস স্কুলে ভরতি করা হয় । তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্ল্যাসিকাল টাইপস্ ( পার্ট ওয়ান ) পরীক্ষায় উচ্চ প্রথমশ্রেণিতে পাস করেন ( ১৮৯২ খ্রি. ) এবং সকল ক্লাসিক্স পুরস্কারগুলি লাভ করেন । দেশে ফিরে তিনি বরােদা রাজ কলেজে অধ্যাপক পদে যােগ দেন । ক্রমে ওই কলেজেরই উপাধ্যক্ষ ও পরে অধ্যক্ষ হন ।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের রাজনৈতিক মতাদর্শ
অরবিন্দ ছিলেন একজন চরমপন্থী মতবাদের সমর্থক । তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শে জাতীয়তাবাদ বলতে বােঝাত জাতীয় জীবনের পরিপূর্ণতা , প্রাচীন ভারতীয় আদর্শ মেনে জনগণের আত্মস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা । অরবিন্দের কাছে দেশ ছিল মৃন্ময়ী নয় চিন্ময়ী , অর্থাৎ রক্ত মাংসের মাতৃস্বরূপা । অরবিন্দ মনে করতেন যে দেশপ্রেম হল সর্বােত্তম ধর্ম । ঠাকুর সাহেবের কাছে দীক্ষিত অরবিন্দের মত ছিল — ‘ রক্ত ও অগ্নিস্নানে পবিত্র হয়ে ’ ( Purification of Blood and Fire ) জাতির চরম আত্মদান । বন্দেমাতরম্ পত্রিকায় তিনি লেখেন — “ স্বরাজ হল বর্তমান অবস্থায় প্রাচীন ভারতীয় আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা — সত্য যুগের জাতীয় গৌরবকে পুনরুদ্ধার করা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেদান্তের আদর্শকে প্রচার করা ” । তিনি বিশ্বাস করতেন — স্বাধীনতা জাতির প্রাণবায়ু , তা কখনাে ভিক্ষা দ্বারা অর্জন করা যায় না ।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে মনোভাব
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে অরবিন্দ নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধের পদ্ধতিরূপে জাতিকে বয়কট নীতি গ্রহণের আহ্বান জানান । বন্দেমাতরম্ পত্রিকায় ‘ The Doctrine of Passive Resistance ‘ নামক প্রবন্ধে তিনি স্বদেশি আন্দোলনের রূপায়ণ পদ্ধতির ওপর নিজের মত প্রকাশ করেন । ইংরেজের পণ্য বয়কট , সরকারি বিদ্যালয় বর্জন , শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সরকারি কর্তৃপক্ষের মুখাপেক্ষিতা বর্জন এবং কর ও খাজনা দান বন্ধ করা — এই ছিল অরবিন্দের সংগ্রামের পদ্ধতি । স্বদেশি আন্দোলনে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকার জন্য তিনি প্রথম সারির নেতারূপে পরিচিতি পান ।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান
মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকে অরবিন্দ মাতৃভূমির শৃঙ্খলমােচনের স্বপ্ন দেখতেন । পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে যােগ দিয়ে তিনি মেদিনীপুর , ঢাকা , খুলনাসহ বেশ কিছু জায়গায় গুপ্ত সমিতি গড়ে তােলার কাজে ব্রতী হন । তাঁর নির্দেশেই সহােদর বারীন্দ্রকুমার ঘােষ ও যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বরােদা থেকে কলকাতায় এসে বাংলায় বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি ও বিপ্লবী দলগুলির সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে তুলতে শুরু করেন । তিনি বাংলার মেদিনীপুরে এসে সত্যেন বসু , হেমচন্দ্র কানুনগােসহ অজস্র যুবকদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেন । তাঁর পরামর্শ মেনেই মানিকতলার বাগানবাড়িতে যুগান্তর দলের প্রধান কর্মকেন্দ্রটি গড়ে ওঠে । বন্দেমাতরম্ পত্রিকায় তিনি লেখেন — “ স্বাধীনতা ও স্বাধিকার মানুষের সহজাত অধিকার ” ।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের পত্রিকা সম্পাদক রূপে কৃতিত্ব
অরবিন্দ বন্দেমাতরম্ পত্রিকার সম্পাদকরূপে লেখেন — স্বরাজ অর্জনের মধ্যে দিয়েই একমাত্র ভারতবর্ষের হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরে আসতে পারে । তিনি আরও লেখেন , একটা বিদেশি জাতি ও সভ্যতার দ্বারা রাহুগ্রস্থ হয়ে থাকলে ভারতবর্ষ কোনােদিনই তার পূর্ণব্রত পালন করতে পারবে না । একসময় ‘ বন্দেমাতরম ‘ পত্রিকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নে সম্পাদকীয়তে লেখা নিয়ে মতবিরােধ দেখা দিলে তিনি বন্দেমাতরম্ পত্রিকা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন । তিনি কে. জি. দেশপাণ্ডে সম্পাদিত ‘ ইন্দু প্রকাশ ’ পত্রিকাতে New Lamps for Old শীর্ষক প্রবন্ধমালায় কংগ্রেসের মূলনীতির ত্রুটি ও প্রাণশক্তির অভাব তুলে ধরে তীব্র ভাষায় সমালােচনা করেন । পাশাপাশি কীভাবে কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তি বাড়তে পারে বা কংগ্রেস কীভাবে জাতির আধাররূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে সে বিষয়েও তিনি তাঁর লেখায় মতপ্রকাশ করেন ।
মুক্তি যুদ্ধের আহ্বান
বঙ্কিম – বিবেকানন্দের মতাে অরবিন্দও দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদকে ধর্মের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । ভবানী মন্দির গ্রন্থে স্বাধীনতা সংগ্রামকে তিনি ধর্মযুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেন । গীতার নিষ্কাম কর্মের ব্যাখ্যা করে তিনি বিপ্লবীদের দেশমাতার মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন । অরবিন্দের জাতীয় মুক্তি সাধনায় বৈদান্তিক চিন্তাধারার প্রতিফলন দেখা যায় । ভবানী মন্দির গ্রন্থে তিনি দেশমাতাকে শক্তির সঙ্গে তুলনা করেন । রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎকালে অরবিন্দকে বলেন — একমাত্র আপনার কাছ থেকেই নির্দেশ আসুক আমরা তা পালন করার জন্য অপেক্ষা করছি ।
আলিপুর বােমা মামলা
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মানিক তলায় মুরারী পুকুর বাগান বাড়িতে বােমা তৈরির সন্ধান পেয়ে পুলিশ অরবিন্দসহ মােট ৩৭ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে । গ্রেফতার হওয়া বিপ্লবীদের আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটকে রেখে শুরু হয় আলিপুর বােমা ষড়যন্ত্র মামলা ( ১৯০৮ খ্রি. ) । চিত্তরঞ্জন দাশের দক্ষ ওকালতিতে অরবিন্দ বেকসুর মুক্তি পান ( ১৯০৯ খ্রি. ৫ মে ) । মামলা চলাকালীন অরবিন্দ দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেছিলেন — “ স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার কারও পক্ষে কোনাে অপরাধ নয় ” ।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের আধ্যাত্মিক জীবন
আলিপুর বােমা মামলা থেকে মুক্ত হয়ে অরবিন্দ রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেন । ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে সমস্তরকম সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারতাত্মার শান্তি কামনায় ও দিব্যজীবনের সাধনায় তিনি দক্ষিণ ভারতের পণ্ডিচেরীতে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হন । এখানে থাকাকালীন তিনি ‘ আর্য ’ নামক এক মাসিক পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ব্যাপারে বেশ কিছু নিবন্ধ লেখেন । এখানে এই আজন্ম বিপ্লবী মহাপুরুষের জীবনাবসান ঘটে ( ১৯৫০ খ্রি. ) ।
মূল্যায়ন
আধ্যাত্ম ভাবপুষ্ট সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠ প্রচারক ছিলেন অরবিন্দ । ভারতবাসীকে তিনি এমন অগ্নিক্ষর অভয় মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন যার বলে তরুণরা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মরণকে তুচ্ছ করতে পেরেছিল । রাজনৈতিক মুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার বিকাশ এই দুইয়ের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়ে অরবিন্দ ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবাদের বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন । তাই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন — “ জাতীয়তাবাদের প্রচারক ও দেশপ্রেমিক কবি ” ( ‘ the prophet of nationalist and the poet of patriotism ‘ ) ।