সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে বিপিনচন্দ্র পালের ভূমিকা
Contents
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে বিপিনচন্দ্র পালের ভূমিকা
ভারতের সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক ও বাগ্মী ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল ( ১৮৫৮ – ১৯০২ খ্রি. ) । তিনিও তিলকের মতােই পূর্ণ স্বরাজে বিশ্বাসী ছিলেন । স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি ‘ নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধ ’ কর্মপন্থা ( Passive Resistance )-র প্রবর্তক ছিলেন । বিশ শতকের প্রথম দশকে তার প্রাণ মাতানাে , আগুন ঝড়ানাে বক্তৃতা , যুক্তিবাদী বিচার বিশ্লেষণ এবং নির্ভীক দৃপ্ত রচনা জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় সমগ্র ভারতকে উদ্বুদ্ধ করে । বিনয় কুমার সরকারের মতে — তিনি ছিলেন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গ বিপ্লবীর জন্মদাতা ও নেতা । অরবিন্দ স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহান পূজারিকে সম্মান জানিয়ে বলেছেন — “ একজন মহান রাজনৈতিক ধর্মবিশ্বাসের প্রবক্তা ” ( The prophet of a great political creed ) ।

বিপিনচন্দ্র পালের প্রথম জীবন
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীহট্টের পইল গ্রামে বিপিনচন্দ্র পাল জন্মগ্রহণ করেন । প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন । ছাত্র জীবনের প্রথম দিকে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন । কিছুদিনের মধ্যেই তিনি রাজনৈতিক গুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন । এসময় তিনি আনন্দ মােহন বসু ও দ্বারকানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে নরমপন্থী রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত হন ।
রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে
বিপিনচন্দ্র পাল প্রথম দিকে ব্রিটিশের প্রতি অনুগত নরমপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন । কিন্তু ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া স্বরুপ তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পূর্ণ পালটে যায় । বিপিনচন্দ্রের রাজনৈতিক মতাদর্শে জাতীয়তাবাদের উৎস ছিল ভারতের শাশ্বত ও চিরন্তন ধর্ম , সংস্কৃতি ও সভ্যতা । তিনি বলতেন — “ আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাইয়া তুলিতে হইবে । এই আত্মবিশ্বাসের দ্বারাই আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারিব ” । সনাতনী আদর্শের মধ্যেই জাতীয়তাবাদের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে তিনি বলেন — “ জাতীয়তাবাদ হল ভগবানের মধ্যে মানবতা ও মানবতার মধ্যে সৃষ্টিকর্তার প্রকাশ ।
বিপিনচন্দ্র পাল সুপণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ বাগ্মী
ইতিহাস , দর্শন , সাহিত্য , রাষ্ট্রবিজ্ঞান , সমাজবিজ্ঞান , শিল্পকলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল । জাতীয় কংগ্রেসের প্রথমযুগে তিনি ছিলেন এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তা । বাগ্মীরুপে তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আগুন ঝড়ানাে বক্তৃতা দিতেন । ভাব ও ভাষার সমন্বয়ে তার ভাষণ দেশবাসীর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল ।
যুব সমাজের প্রেরণা :
যুব সমাজের মনে জাতীয়তাবাদী প্রেরণা জোগানাের জন্য বিপিনচন্দ্র পত্র পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন ও বিভিন্ন সভায় ভাষণ দেন ।
লেখনীর মাধ্যমে :
বিপিনচন্দ্র ‘ নিউ ইন্ডিয়া ’ পত্রিকার মাধ্যমে স্বদেশবাসীকে আত্মনির্ভরশীল হতে বলেন । ‘ বন্দেমাতরম ‘ পত্রিকায় তিনি নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধের আদর্শ প্রচার করেন । এই দুই পত্রিকায় তার ক্ষুরধার লেখনী বাংলা তথা ভারতীয় যুব সমাজকে স্বাদেশিকতায় দীক্ষিত করে । ‘ কায়স্থ সমাচার ’ পত্রিকায় দুটি প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে তিনি কারিগরি শিক্ষা ও শিল্পে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেন ।
বক্তৃতার মাধ্যমে
সুবক্তারূপে বিপিনচন্দ্র তার বৈপ্লবিক মতাদর্শ সুতীক্ষ্ণ ভাষায় প্রচার করেন । বক্তৃতার মাধ্যমে একদিকে তিনি যুব সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যােগ দেওয়ার প্রেরণা দেন , অপরদিকে জাতীয় আন্দোলনে নরমপন্থীর বিপরীত চরমপন্থী মতাদর্শকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন ।
লাল-বাল-পাল এর মধ্যমণি
ভারতের রাজনীতিতে লালা লাজপত রায় , বালগঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল এই ত্রয়ীকে নিয়ে যে লাল-বাল-পাল যুগের সূচনা ঘটেছিল , তার অন্যতম রত্ন ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল । তিলক ও লাজপত রায়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রথমযুগে নরমপন্থী গােষ্ঠীর পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে চরমপন্থী গােষ্ঠী তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা নেন ।
স্বদেশি আন্দোলনের নেতা
বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন শুরু হলে তিনি ভারতীয় জাতীয় নেতাদের ব্রিটিশদের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে অসহযােগের নীতি অনুসরণের পরামর্শ দেন । এ সময়ে তিনি দেশবাসীর প্রতি স্বদেশি আন্দোলনকে সফল করার আহ্বান জানান । লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ নীতি বিপিনচন্দ্রকে পূর্ণমাত্রায় চরমপন্থীতে রূপান্তরিত করে । এই সময় থেকেই চরমপন্থী নেতারূপে বিপিনচন্দ্র ‘ স্বরাজ ’ অর্জনকে জীবনের একমাত্র ব্রত বলে গ্রহণ করেন । বিনয় কুমার সরকারের মতে , বিপিনচন্দ্ৰই ছিলেন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ বিপ্লবের জন্মদাতা ও নেতা ।
পূর্ণ স্বরাজ ধারণার উদ্গাতা
বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন পূর্ণ স্বরাজ ধারণার এক অন্যতম উদ্গাতা । তিনি তিলকের মতােই পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের ব্রত নিয়ে বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করেন । তিনি বলেন — “ স্বরাজ কেহ দান করিতে পারে না , ইহা নিজেকেই অর্জন করিতে হয় । আজ যদি ইংরাজ বলে , স্বরাজ নাও , আমি ধন্যবাদ দিয়া প্রত্যাখ্যান করিব । কারণ , আমি নিজে যাহা অর্জন করিতে পারি না , তাহা গ্রহণ করার অধিকার আমার নাই ” ।
কারাবরণ
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বন্দেমাতরম পত্রিকায় রাজদ্রোহিতামূলক লেখা প্রকাশের অপরাধে সম্পাদক অরবিন্দকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয় । এই মামলায় অরবিন্দ ঘােষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানে অস্বীকার করায় তাঁর ছয় মাস জেল হয় । মুক্তিলাভের ( ৯ মার্চ , ১৯০৮ খ্রি. ) পর বিপিনচন্দ্র বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন । পরে বিলেতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের জন্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আবার এক মাসের কারাদণ্ড হয় ।
মূল্যায়ন
বিপিনচন্দ্রের বাগ্মিতা শক্তিতে সমগ্র জাতি উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল । অরবিন্দ ঘােষের মতে — তিনি জাতীয়তার একজন শ্রেষ্ঠ প্রবর্তক ছিলেন । মাদ্রাজের জাতীয়তাবাদী নেতা চিদাম্বরম পিল্লাই তাঁকে ‘ স্বাধীনতার সিংহ ’ উপাধি দেন । ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুতে ভারতবাসী এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতাকে হারায় । বিপিনচন্দ্রের জীবন ও কাজের মধ্যে প্রতিভাত হয়েছিল ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতের স্বপ্নালু চিত্র । রাজনীতিবিদরূপে বিপিনচন্দ্র পাল বিশ্বাস করতেন — একটি ভালাে সরকার কখনােই স্বশাসনের বিকল্প নয় ( ‘ Good Government is no substitute for self – Government ‘ ) ।