ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের অবদান
Contents
ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের কেশবচন্দ্র সেনের অবদান
ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনকে চূড়ান্ত ভাবে গতিশীল ও সফল করেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন । এক নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান ও দর্শন শাস্ত্রের ছাত্র হয়ে তিনি যেভাবে সেসময়কার ভারতবর্ষের ধর্মীয় অনাচার ও সামাজিক কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তা পরবর্তী প্রজন্মের ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারকদের কাছে অনুসরণ যােগ্য ছিল । রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে — মূলত কেশবচন্দ্র সেনের ব্যক্তিত্বের জন্যই ব্রাহ্ম সমাজ শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ।

কেশবচন্দ্র সেনের আচার্যপদ গ্রহণ
কেশবচন্দ্রের বহুমুখী প্রতিভার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ ব্রহ্মানন্দ ’ উপাধিতে ভূষিত ( ১৮৬২ খ্রি. ) করেন । কেশবচন্দ্র সেন ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রথম অব্রাহ্মণ ( বৈষ্ণব ) আচার্য । আচার্যরূপে তিনি জোর দিয়েছিলেন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতির ওপর । আর বিশেষত নারী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে , সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূর করে , জাতিভেদ প্রথার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তিনি যুব সমাজে এক বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন ।
কেশবচন্দ্র সেনের ধর্ম সংস্কার
মূর্তি পূজার বিরােধী কেশবচন্দ্র চেয়েছিলেন ধর্মীয় পূজা পার্বণে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ হােক । উপবীত ধারণকারী ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাঁর বিরােধ বাধলে তিনি ব্রাহ্মসমাজ থেকে বহিষ্কৃত ( ১৮৬৬ খ্রি. ) হন । তিনি সে বছরেই আলাদাভাবে ‘ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ’ প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮৬৬ খ্রি. ১১ নভেম্বর ) । ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন সকল ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখা , সকল সম্প্রদায় ও সকল শাস্ত্রের সত্যকে সম্মান দানের লক্ষ্যে ব্রাহ্ম ধর্মকে সর্বধর্ম সমন্বয়কারী নববিধান হিসেবে ঘােষণা করেন ।
কেশবচন্দ্র সেনের সমাজ সংস্কার
১৮৬০ খ্রি. তিনি ‘ সংগতসভা ’ ও ‘ ব্রাহ্মবন্ধু সভা ’ প্রতিষ্ঠা করে তরুণ ব্রাহ্মদের সমাজ সেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন । নারী মুক্তির পাশাপাশি তিনি জাতিভেদ প্রথার অবসান চান এবং অসবর্ণ ও বিধবা বিবাহকে সমর্থন করেন । তিনি পর্দা প্রথার অবসান ঘটিয়ে নারীদের সমাজের সামনের সারিতে আনতে চেয়েছিলেন । নারীদেরও তিনি ব্রাহ্মসমাজের সদস্যা হওয়ার অধিকার দেন ।
নারীদের কল্যাণ ও সমাজে তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি বামাবােধিনী সভা ( ১৮৬৩ খ্রি. ) ও ব্রাহ্মিকাসমাজ ( ১৮৬৫ খ্রি. ) প্রতিষ্ঠা করেন । তাঁর প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার ‘ তিন আইন ’ ( Act III of 1872 ) পাস করিয়ে বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ প্রথা রদ এবং অসবর্ণ বিবাহকে আইনসিদ্ধ করে । পাটকল শ্রমিকদের জন্য বস্তিতে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা , নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের সমাজের মূল জীবন ধারায় ফিরিয়ে আনা , মদ্যপান বিরােধী প্রচার ইত্যাদি কর্মসূচি তিনি গ্রহণ করেছিলেন ।
কেশবচন্দ্র সেনের শিক্ষা সংস্কার
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও একাধিক স্কুল প্রতিষ্ঠার দ্বারা তিনি শিক্ষার প্রসার ও উন্নতি ঘটানাের চেষ্টা করেন । এ ছাড়াও তিনি অজস্র পুস্তক লিখে গেছেন , যেগুলি থেকে তাঁর আদর্শ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানা যায় । ‘ ইন্ডিয়ান মিরর ’ ( ১৮৬১ খ্রি. ) , ‘ পরিচারিকা ’ ( ১৮৬৩ খ্রি. ) , বামাবােধিনী পত্রিকা ( ১৮৬৩ খ্রি. ) , ধর্মতত্ত্ব ( ১৮৬৪ খ্রি. ) , ‘ সুলভ সমাচার ‘ প্রভৃতি পত্রিকার মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষের মনে চেতনা সঞ্চারের চেষ্টা করেন । ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কোলুটোলায় প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন । ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কেশবচন্দ্র নেটিভ লেডিস ফর্ম্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন , যার পরে নাম হয় ( ১৮৮২ খ্রি. ) নেটিভ লেডিস ইন্সটিটিউশন ( এখনকার ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন ) । এ ছাড়া তিনি ক্যালকাটা কলেজ ( ১৮৬২ খ্রি. ) এবং অ্যালবার্ট কলেজও ( ১৮৭২ খ্রি. ) প্রতিষ্ঠা করেন ।
মূল্যায়ন
একজন সংস্কারক রুপে কেশবচন্দ্র শুধুমাত্র দেশীয় গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকেননি । তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই সংস্কারক রূপে ব্রাহ্মসমাজকে পরিচালনা করেছিলেন । এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজেরই একটি উক্তি প্রণিধানযােগ্য — প্রভু যিশু আমার ইচ্ছা , সক্রেটিস আমার মস্তিষ্ক , শ্রীচৈতন্য আমার হৃদয় , হিন্দু ঋষি আমার আত্মা এবং দার্শনিক হাওয়ার্ড আমার দক্ষিণ হস্ত ( ‘ The Lord Jesus is my will , Socrates my head , Chaitanya my heart , the hindu Rishi my soul and Philanthropic Howard my right hand ‘ ) ।