ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটির লক্ষ্য / অবদান / ব্যর্থতা
Contents
ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটির লক্ষ্য / অবদান / ব্যর্থতা
উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতের সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ‘ থিওসফিক্যাল সােসাইটি ’। হেলেনা পেট্রোভনা মাদাম ব্লাভটস্কি নামে এক রুশ মহিলা ও কর্নেল হেনরি স্টিল ওলকট নামে এক ব্রিটিশ সামরিক অফিসার ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থিওসফিক্যাল সােসাইটি স্থাপন করেন । ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা আর্য সমাজের আমন্ত্রণে ভারতে আসেন ও মাদ্রাজের উপকণ্ঠে আডিয়ারে থিওসফিক্যাল সােসাইটির ভারতীয় শাখাটি ( ১৮৮৬ খ্রি. ) স্থাপন করেন । পরবর্তীকালে এটিই সােসাইটির প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয় ।

ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটির লক্ষ্য
ইংরেজি শব্দ ‘ থিওসফি ’ -র অর্থ হল ‘ ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান ’ । বাংলা বা সংস্কৃতে যা ‘ ব্ৰহ্ম জ্ঞান ’ হিসেবে পরিচিত । খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে গ্রিক পণ্ডিত আয়ামবেচস সর্বপ্রথম ‘ থিওসফি ’ শব্দটির উল্লেখ করেন । থিওসফিক্যাল সােসাইটির মূল কয়েকটি লক্ষ্য ছিল —
- জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন ।
- প্রাচীন হিন্দুধর্মের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনা ।
- দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার আদর্শে সকলকে অনুপ্রাণিত করা ।
- হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তােলা ।
- ধর্ম , দর্শন ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ও চর্চায় উৎসাহ দান ইত্যাদি ।
ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটি অ্যানি বেসান্ত এর ভূমিকা
আইরিশ মহিলা অ্যানি বেসান্ত সােসাইটিতে যােগদান করলে ( ১৮৮৯ খ্রি. ) এটি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে । তাঁরই চেষ্টায় ভারতের নানা স্থানে এর শাখা প্রশাখা গড়ে ওঠে । বেসান্তের চেষ্টায় কাশীতে স্থাপিত হয় কেন্দ্রীয় হিন্দু বিদ্যালয় । ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্যালয়টি মদনমােহন মালব্যের উদ্যোগে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয় । বেসান্তের মতে — ভারতে থিওসফিক্যাল সােসাইটির প্রধান কাজ হল হিন্দু , জরথুস্ট্রীয় ও প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটানাে । বেসান্ত বলতেন — “ হিন্দু আদর্শের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পরাধীন ভারতবাসী ফিরে পাবে তার আত্ম সম্মান , দেশাত্ম বােধ ও স্বাধীনতা । ”
ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটির অবদান
এই সােসাইটির কিছু উল্লেখযােগ্য অবদান হল —
হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান :
থিওসফিক্যাল সােসাইটির উদ্যোগে গড়ে ওঠা আন্দোলন হিন্দু ধর্মের নব উত্থানে সাহায্য করেছিল ।
ধর্মীয় বিশ্বাস :
থিওসফিক্যাল আন্দোলন স্বদেশবাসীকে নিজ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখতে সাহায্য করেছিল ।
বিদেশি বিদ্বেষ হ্রাস :
বেসান্ত বিদেশি সংস্কার ( বন্দিশালার সংস্কার , হাসপাতালের রুগিদের সঙ্গ দান ) – এর আদর্শ এদেশে প্রচলন করলে বিদেশিদের প্রতি ভারতীয়দের বিদ্বেষের ধারণা অনেকটাই পরিবর্তিত হয় ।
ভারতে থিওসফিক্যাল সোসাইটির ব্যর্থতা
থিওসফিক্যাল সােসাইটির কিছু ব্যর্থতাও ছিল ।
জনপ্রিয়তা হ্রাস :
হিন্দু ধর্মের মূর্তি পূজা ও আচার অনুষ্ঠানকে সমর্থন করে থিওসফিক্যাল সােসাইটি প্রথম দিকে জনপ্রিয়তা পেলেও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেনি ।
নগর কেন্দ্রিক :
থিওসফিক্যাল আন্দোলন মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুষ্টিমেয় শহুরে ভারতীয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । গ্রামীণ সাধারণ দরিদ্র ভারতীয়দের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনাে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ।
হিন্দু ধর্ম কেন্দ্রিক :
থিওসফিক্যাল আন্দোলন হিন্দু জাতীয়তাবাদ কেন্দ্রিক হওয়ায় ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে ।
মূল্যায়ন
থিওসফিস্টরা হিন্দু ধর্ম ও ঐতিহ্যের পক্ষে প্রচারে নামলে ভারতীয়দের হারানাে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে । জওহরলাল নেহরু এই সংস্থাটির প্রশংসা করে তাঁর ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ’ গ্রন্থে লিখেছেন — “ থিওসফিক্যাল সােসাইটি ভারতীয় মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তােলে ”।