রাজা রামমোহন রায়ের ধর্ম সংস্কার

Contents

রাজা রামমোহন রায়ের ধর্ম সংস্কার

রামমােহন বিশ্বাস করতেন যে জাতিকে অজ্ঞতা ও জড়তা থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদ । তাই তিনি প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ও শাশ্বত চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ ভাবধারার সমন্বয় ঘটিয়ে নবভারত গড়ে তােলার স্বপ্ন দেখেছিলেন ।

Raja Ram Mohan Roy ili 82 img 5
রাজা রামমোহন রায়

রামমোহন রায়ের কুসংস্কার বিরোধী ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রচেষ্টা

ধর্মীয় ক্ষেত্রে রামমােহন এক যুক্তিবাদী মন নিয়ে চিন্তার স্বচ্ছতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা ধর্মীয় কুসংস্কারগুলি দূর করার উদ্যোগ নেন । উপনিষদের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লােকহিতে ব্রতী হন । দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত পৌত্তলিকতাকেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠানে হিন্দুদের প্রান্তবিশ্বাস দেখে তিনি দুঃখ পান । তাই তিনি এ প্রসঙ্গে লেখেন — “ আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি হিন্দুরা ধর্মের যে বর্তমান প্রথা মেনে চলেন তা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার পক্ষে উপযুক্ত নয় । ” তিনি চেয়েছিলেন সর্বধর্মের মধ্যে মৈত্রী ও সৌহার্দ গড়ে উঠুক এবং ভাবের আদানপ্রদান হােক ।

রামমোহন রায়ের একেশ্বরবাদী প্রচার

রামমােহন হিন্দুধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না । রামমােহন সর্বপ্রথম ফারসি ভাষায় ‘ তুহফাৎ – উ – মুয়াহিদ্দিন ’ শীর্ষক রচনায় পৌত্তলিকতাবাদ , অলৌকিক তত্ত্ব , বহুঈশ্বরবাদ , অবতারবাদ ইত্যাদির বিরােধিতা করেন । বেদ , বেদান্ত , উপনিষদ , ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে তিনি ঘােষণা করেন সব ধর্মই মূলত একেশ্বরবাদী । তিনি বলেন পৌত্তলিকতাই হিন্দুধর্মের শেষ কথা নয় । একেশ্বরবাদী ভাবধারায় ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়কে একত্রিত করার লক্ষ্যে তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুর , পাদ্রি অ্যাডাম‌্স প্রমুখের সাহায্যে কলিকাতা ইউনিটেরিয়াম কমিটি গঠন করেন ( ১৮২১ খ্রি. ) ।

রামমোহন রায়ের আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা

রামমােহন হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও পৌত্তলিকতাবাদের বিরােধিতা করার লক্ষ্যে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ আত্মীয় সভা ‘ প্রতিষ্ঠা করেন । আত্মীয় সভার বিভিন্ন অধিবেশনে হিন্দুধর্মের মূর্তিপূজার অসাড়তা , সতীদাহ প্রথা ও জাতিভেদ প্রথা বিষয়ে আলােচনা হত । আত্মীয় সভার সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর , নন্দকিশাের বসু , প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ ।

রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসভা গঠন

একেশ্বরবাদের প্রচার ও ধর্মীয় চেতনার বিকাশের লক্ষ্যে রামমােহন ব্রাহ্মসভা গঠন ( ১৮২৮ খ্রি. ) করেন । রামমােহন ব্রাহ্মসভার মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দুধর্মের রক্ষকদের গোঁড়ামিতে আঘাত করতে চেয়েছিলেন । প্রত্যেক শনিবার ( পরে বুধবার ) সন্ধ্যায় এই সভার প্রার্থনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ব্ৰহ্মসংগীত পরিবেশন , বৈদিক শ্লোকের ব্যাখ্যা , বেদ – উপনিষদ পাঠ করা হত ।

রামমোহন রায়ের বেদান্ত শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার

রামমােহন মনে করতেন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাই প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ দান । তাই তিনি বাংলা ভাষাতে বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেছিলেন । এমনকি অদ্বৈতবাদ প্রচারের জন্য তিনি বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮২৫ খ্রি. ) । তিনি ঈশ , কঠ , কেন , মন্ডুক , মান্ডুক্য এই পাঁচ উপনিষদের ভাবানুবাদ করেন ।

মূল্যায়ন

উনিশ শতকে রামমােহন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মিলন , জনশিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে একদিকে যেমন একজন শিক্ষাসংস্কারক , অপরদিকে তেমন উদার মানসিকতা , যুক্তিবাদী মননশীলতায় নিজেকে একজন শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকরূপে প্রমাণ করেছিলেন । রামমােহনের জীবনীকার সােফিয়া – ডি – কোলেট সংস্কারক রামমােহনের মুল্যায়নে  লিখেছেন – “ ইতিহাসে রামমােহন হলেন এক জীবন্ত সেতু , যার ওপর দিয়ে ভারতবর্ষ তার বিশাল অতীত থেকে অসীম ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হয়েছে ” ( Rammohan stands in History as a living bridge over which India marches from her unmeasured past to her incalculable future ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!