ইতিহাস

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ

Contents

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ

এই সভ্যতার পতনের কোনাে নির্দিষ্ট কারণ স্থির করা যায়নি । বস্তুত কোনাে একটিমাত্র কারণে বা আকস্মিক এত উন্নত সভ্যতার পতন ঘটা সম্ভব নয় । প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এজন্য একাধিক কারণের উল্লেখ করেছেন । আধুনিক পণ্ডিতদের স্থির বিশ্বাস যে , হরপ্পার পতনের মূল কারণ ছিল তার অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় । | এই অবক্ষয় এসেছে ধীরে ধীরে এবং সংগােপনে । অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের ফলে সভ্যতার ভিত দুর্বল হয়ে না পড়ার পরে কিছু কিছু বহিরাগত সংকট এর পতন অনিবার্য করে তােলে ।

লোথাল ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ কর্তৃক প্রকাশিত
হরপ্পা সভ্যতা

ভূ প্রকৃতির পরিবর্তন

ভূ প্রকৃতির পরিবর্তন এই প্রাচীন সভ্যতার অবক্ষয় ডেকে এনেছিল । একদা সিন্ধু অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত । কিন্তু ক্রমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায় । ফলে সিন্ধু অঞ্চলে মরুভূমি জেগে ওঠে । মরুর প্রভাবে ভূ – স্তরের নীচের জল ক্রমশ লােনা হতে থাকে । ফলে কৃষি – উৎপাদন অত্যন্ত কমে যায় এবং খাদ্যাভাব তীব্রতর হয় ।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়

অনেকের মতে , প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই সভ্যতার পতনের প্রধান কারণ । ‘ জলবিজ্ঞান ’ বিষয়ক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে , সিন্ধু – উপত্যকার নিকটবর্তী অঞলে ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল । সম্ভবত ভূমিকম্প থেকে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটেছিল । রাইখস – এর মতে , ক্রমাগত বন্যা ও প্লাবন সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ ঘটিয়েছিল । সিন্ধুবাসী নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষ – আবাদ করত । ফলে সিন্ধুনদে পলি পড়ে যায় এবং জলােচ্ছাস ঘটে । খননকার্যের ফলে অন্তত তিনটি বিধ্বংসী বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে ।

স্থবিরতা

হরপ্পা , মহেন-জো-দারাের ক্রমিক অবক্ষয়ের আর – একটি কারণ ছিল এর স্থবিরতা । আধুনিক চাষ – আবাদ কিংবা নিরাপত্তার দিকে সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতাগুলির আগ্রহ থাকলেও সিন্ধু – উপত্যকার অধিবাসীরা সে – বিষয়ে নিস্পৃহ ছিল । জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরােনাে ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটাতেই তারা বেশি আগ্রহী ছিল । সমকালীন অন্যান্য সভ্যতার উন্নত চাষ – আবাদ পদ্ধতি বা অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে সিন্ধুবাসী অবহিত ছিল । কিন্তু নিজেদের জীবনে সেই উন্নত রীতির প্রয়ােগ ঘটাতে তারা আদৌ আগ্রহী ছিল না । এই স্থবিরতা তাদের জনজীবনকে অক্ষম ও পঙ্গু করে তুলেছিল ।

বনাঞ্চল ধ্বংস

সিন্ধুবাসী বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পােড়া ইটের বাড়ি তৈরি করেছিল । ইট পােড়ানাের জন্য তারা যথেচ্ছভাবে বন – জঙ্গল ধ্বংস করে । বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্রুত কমে যায় । প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রজেল – এর মতে , বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বন‍্য জন্তুর সংখ্যাও হ্রাস পায় । অথচ একটি সভ্যতার টিকে থাকার জন্য এগুলি ছিল অপরিহার্য ।

অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ

সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হিসেবে অধিকাংশ পণ্ডিত সংঘাত ও রক্তপাতকে নির্দিষ্ট করেছেন । তবে এই সংঘাত ও রক্তপাত কেন ঘটেছিল সে – বিষয়ে দ্বিমত আছে , কার‌ও মতে অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ থেকেই এই রক্তপাত ও অনিবার্য ধ্বংস ঘটেছে ।

বহিরাক্রমণ

অনেকের ধারণা বহিরাগত শত্রুর আক্রমণের ফলেই সিন্ধু সভ্যতার পতন অনিবার্য হয় । এঁরা প্রধানত বৈদিক আর্যদের আক্রমণকে হরপ্পার পতনের জন্য দায়ী করেন । ধ্বংসস্তূপে আবিষ্কৃত মৃতদেহের কঙ্কালে ভারী বস্তুর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং আর্যরা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করত এটাও প্রমাণিত সত্য । তা ছাড়া ঋগবেদে ইন্দ্রকে পুরন্দর বলে বর্ণনা করা হয়েছে । ‘ পুরন্দর ’ অর্থে পুর বা নগর ধ্বংসকারী । আবার সিন্ধু – উপত্যকার অধিবাসীরা নগরে বসবাস করত । তাই আর্যদের সিন্ধু উপত্যকায় গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসকারী বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক ।

বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কোনাে সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় করা খুব সহজ নয় । তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে , চরম বিকাশের পর সিন্ধু – সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হয়েছিল । ক্রমে তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল । সেই সময় হয়তাে বহিঃশত্রুর আকস্মিক আক্রমণ এই সভ্যতার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!