গৌতম বুদ্ধের ধর্মমত
Contents
গৌতম বুদ্ধের ধর্মমত

পরম জ্ঞান লাভ করার পর বুদ্ধ বারাণসীর কাছে তারকনাথে পঞ্চভিক্ষু অর্থাৎ পাঁচজন সন্ন্যাসীর কাছে তাঁর লব্ধ জ্ঞান বিতরণ করেন । এই ঘটনা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত । এরপর ৪৫ বছর তিনি কাশী , কোশল , মগধ প্রভৃতি স্থানে ধর্মপ্রচার করেন । মগধরাজ বিম্বিসার , অজাতশত্ৰু , কোশলরাজ প্রসেনজিৎ – সহ বহু পুরুষ ও নারী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । বুদ্ধের শিষ্যরা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিলেন , যথা — উপাসক ও ভিক্ষু । উপাসক হলেন যাঁরা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেও সংসার ধর্ম পালন করতেন এবং ভিক্ষু হলেন যাঁরা সন্ন্যাস গ্রহণ করতেন । অবশেষে প্রায় ৮০ বছর বয়সে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে বুদ্ধদেব দেহত্যাগ করেন ( আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ ) ।
গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্যসত্য
বুদ্ধদেব অতি সহজ ও সরল ভাষায় তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন । বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হল সত্যকে উপলদ্ধি করা । বুদ্ধ বলেছেন , সমুদ্রের যেমন একটি মাত্র স্বাদ অর্থাৎ লবণ , আমার ধর্মেরও তেমনি একটিমাত্র লক্ষ্য এবং তা হল দুঃখের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা । বুদ্ধের মতে , মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় নতুন দেহে জন্মলাভ করে । জন্মলাভ করে জীবকে কর্ম করতে হয় । কর্ম থেকে আসে ‘ আসক্তি ’। আসক্তি নিয়ে আসে ‘ দুঃখ ’ । পুনর্জন্ম গ্রহণ করে সেই দুঃখ ভােগ করতে হয় । কর্মফলজনিত পুনর্জন্ম রদ করে দুঃখের হাত থেকে মুক্তি লাভের একমাত্র পথ হল কামনা , বাসনা ও আসক্তি ইত্যাদি দূর করা । এজন্য বুদ্ধদেব মানুষকে চারটি আর্যসত্য উপলব্ধি করার পরামর্শ দিয়েছেন । চারটি আর্যসত্য হল —
- এ পৃথিবী দুঃখময় ,
- মানুষের কামনা , বাসনা ও আসক্তি থেকেই দুঃখের সৃষ্টি হয় ( ‘ সমুদয় ‘ ) ,
- কামনা , বাসনা ও আসক্তিকে নিবৃত্ত করতে পারলে মুক্তিলাভ সম্ভব ( ‘ নিরােধ ’ ) এবং
- কামনা , বাসনা , আসক্তি দূর করার জন্য নির্দিষ্ট পথ ( বা ‘ মার্গ ’ ) অনুসরণ করা দরকার । এইভাবে আত্মার মুক্তি সম্ভব । এই মুক্তিকে তিনি নির্বাণ নামে অভিহিত করেছেন ।
গৌতম বুদ্ধের অষ্টাঙ্গিক মার্গ
আসক্তিমুক্ত হয়ে নির্বাণলাভের জন্য বুদ্ধদেব আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে বলেছেন । এই আটটি পথ হল — সৎ-বাক্য , সৎ-কর্ম , সৎ-সংকল্প , সৎ-চেষ্টা , সৎ-জীবিকা , সৎ-চিন্তা , সৎ-চেতনা ও সৎ-সমাধি । অষ্টাঙ্গিক মার্গের সাথে তিনটি বিষয় গভীরভাবে জড়িত । এগুলি হল শীল , চিত্ত ও প্রজ্ঞা । ‘ শীল ’ হল নৈতিক শুদ্ধতা , ‘ চিত্ত ’ হল ধ্যানের দ্বারা মানসিক সংযােগ স্থাপন এবং ‘ প্রজ্ঞা ’ হল পরম জ্ঞান । ত্রিপিটকে ‘ শীল ’ , ‘ চিত্ত ’ ও ‘ প্রজ্ঞা ’ অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে । অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রধান লক্ষ্য হল সৎ পথে থেকে অহিংসার মাধ্যমে সত্যকে উপলদ্ধি করা । সৎ পথে অহিংসা অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক সংঘাত বর্জন করে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করার উদ্দেশ্যে বুদ্ধদেব এই মার্গ অনুশীলনের উপর বিশেষ জোর দেন । বুদ্ধের নির্দেশিত এই কর্মগুলির মধ্যে যেমন চরম ভােগের প্রকাশ ছিল না , তেমনি ছিল না কঠোর কৃচ্ছসাধন । তাই এগুলি মধ্যপন্থা বা মঝ্ঝিম পন্থা নামে অভিহিত হয়েছে ।
বৌদ্ধ ধর্মের পঞ্চশীল
বুদ্ধদেব তাঁর অনুগামীদের কয়েকটি নৈতিক আচরণবিধি পালনেরও পরামর্শ দিয়েছেন , যথা — চুরি না-করা , ব্যভিচারী না-হওয়া , অসত্য পরিহার করা , হিংসা না-করা এবং অন্যায় না-করা । এই নীতিগুলি পঞ্চশীল নামে পরিচিত ।
বৌদ্ধ ধর্ম সংঘ
বৌদ্ধধর্মে ‘ সংঘ ’ এর বিশিষ্ট ভূমিকা আছে । বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সংঘে থেকে ধর্মাচরণ করতে পারেন । নারীরাও বৌদ্ধ সংঘের সদস্যা হতে পারেন । তবে নারীদের জন্য স্বতন্ত্র সংঘ স্থাপন বাধ্যতামূলক । সংঘের জন্য বুদ্ধদেব কতগুলি আচরণবিধিও স্থির করেছেন ।
বৌদ্ধ সংগীতি
বুদ্ধের জীবিতকালে তাঁর উপদেশাবলি লিপিবদ্ধ করা হয়নি । তাঁর দেহত্যাগের পরে রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধসংগীতি ( সম্মেলন ) আহূত হয় । এখানে বুদ্ধের উপদেশগুলি তিনটি খণ্ডে সংকলিত করা হয় । এই খণ্ডগুলি বিনয়পিটক , সুত্ত পিটক ও অভিধর্মপিটক নামে পরিচিত । তিনটি পিটক একত্রে ত্রিপিটক নামে খ্যাত । বিনয়পিটক – এ বুদ্ধ – নির্দেশিত ধর্মীয় আচার , সুত্তপিটকে তাঁর ধর্মীয় উপদেশাবলি এবং অভিধর্মপিটকে বৌদ্ধদর্শনের কথা লিপিবদ্ধ করা আছে । এ ছাড়া বুদ্ধের জীবনকাহিনিভিত্তিক জাতক উপাখ্যানগুলিও বৌদ্ধ – সাহিত্যের অংশরূপে বিবেচিত হয় ।
খুব সুন্দর আলোচনা, আরও জানার কৌতূহল রইলো।