গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বাণী
Contents
গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বাণী

ধর্মাশ্রয়ী ভারতের মাটিতে যে সকল ধর্মমত উল্লেখযোগ্য প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল , বৌদ্ধ ধর্ম তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান । বৌদ্ধ ধর্মের উদগাতা গৌতম বুদ্ধ ছিলেন চীন ও পারস্যের দুই বিখ্যাত ধর্ম প্রচারক কনফুসিয়াস ও জরথ্রুষ্ট এর সমসাময়িক । কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে গৌতম বুদ্ধের ধর্মমত যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কনফুসিয়াস বা জরথুষ্ট মতাদর্শ তা পায়নি । এজন্য কোশাম্বী বুদ্ধকে বিদেশীদের কাছে ‘ ভারতের শ্রেষ্ঠ দান ‘ বলে বর্ণনা করেছেন । ঐতিহাসিক ব্যাসামের ভাষায় : ‘ বুদ্ধ ছিলেন এতাবৎকালে ভারতের শ্রেষ্ঠ সন্তান । ‘
গৌতম বুদ্ধের জন্ম ও বংশ পরিচয়
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জন্ম তারিখ সম্পর্কে মতভেদ আছে । অনেকের মতে , তিনি ৫৬৩ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । আবার সিংহলী গ্রন্থদ্বয় মহাবংশ ও দীপবংশে উল্লিখিত গৌতমের দেহ রক্ষার তারিখ বিশ্লেষণ করে অনেকে বলেন , তিনি ৬২৩ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ।
বুদ্ধের পূর্বনাম ছিল সিদ্ধার্থ । গৌতম গোত্রজাত বলে ‘ গৌতম ‘ নামেও পরিচিত ছিলেন । পিতার নাম শুদ্ধোদন ও মাতার নাম মায়া । গৌতম কলিপাবস্তুর লুম্বিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে করা হয় । ষোল বৎসর বয়সে গোপা বা যশোধরা নামে এক রাজকন্যার সাথে তাঁর বিবাহ হয় ।
কিন্তু রাজ ঐশ্বর্যের মধ্যে বাস করেও গৌতমের মনে শান্তি ছিল না । জীবনের দুঃখ কষ্ট , জরা , মৃত্যু তাঁর মনে বৈরাগ্যের সঞ্চার করে । সংসারের এই দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের জন্য তাঁর মন ছিল সতত আকুল । অবশেষে মাত্র ২৯ বৎসর বয়সে যেদিন পুত্র রাহুল ভূমিষ্ঠ হয় , সেদিনই রাত্রে তিনি গৃহত্যাগ করেন । পরবর্তীকালে তাঁর গৃহত্যাগের এই ঘটনা ‘ মহাভিনিষ্ক্রমণ ‘ নামে অভিহিত হয় ।
আরো পড়ুন : গৌতম বুদ্ধের ধর্মমত
গৌতম বুদ্ধের বোধি লাভ
গৃহ ত্যাগ করার পর গৌতম আলারা কালামা নামক এক ঋষির সান্নিধ্যে আসেন । তাঁর কাছে ধ্যানের পদ্ধতি ও ব্রহ্মবিদ্যা আয়ত্ত করেন । এরপর চরম কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে কর্মবন্ধন ক্ষয় করার প্রয়াসে রত পাঁচজন সন্ন্যাসীর সাথে গৌতম মিলিত হন । কঠোর কৃচ্ছ্বসাধনের ফলে তিনি চলমান কঙ্কালে পরিণত হন । কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন এভাবে পরম সত্য জানা যাবে না ।
অতঃপর তিনি বোধগয়ায় এক পিপল বৃক্ষের ছায়ায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হন । একাসনে যোগারূঢ় অবস্থায় ৪৯ দিন থাকার পর তিনি সত্যকে উপলব্ধি করতে পারেন । দুঃখের গোপন রহস্য তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় । আবার এই দুঃখ থেকে মুক্তির পথের সন্ধানও তিনি লাভ করেন । এইভাবে ‘ পরম জ্ঞান ‘ বা ‘ বোধি ‘ লাভ করার জন্য তিনি ‘ বুদ্ধ ’ এবং সত্যের পথ আবিষ্কারের জন্য ‘ তথাগত ‘ নামে পরিচিত হন ।
ধর্ম চক্র প্রবর্তন
‘ পরম জ্ঞান ’ লাভ করার পর এই জ্ঞান মানুষের মধ্যে প্রচার করবেন । কিনা , সে বিষয়ে প্রথমে বুদ্ধের মনে দ্বিধা ছিল । অবশেষে তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন এবং মৃগবনে ‘ পঞ্চ ভিক্ষু ‘ অর্থাৎ পাঁচজন সন্ন্যাসীর নিকট সর্বপ্রথম তা ব্যাখ্যা করেন । এই ঘটনা ‘ ধর্ম চক্র প্রবর্তন ‘ নামে খ্যাত ।
এর পর প্রায় ৪৫ বৎসর ধরে তিনি কাশী , কোশল , মগধ প্রভৃতি স্থানে তাঁর ধর্মপ্রচার করেন । মগধরাজ বিম্বিসার , অজাতশত্রু , কোশলরাজ প্রসেনজিৎ সহ বহু পুরুষ ও নারী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । বুদ্ধের শিষ্যগণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন , যথা-
( ১ ) উপাসক অর্থাৎ যাঁরা শিষ্যত্ব গ্রহণ করেও সংসারে থাকতেন এবং
( ২ ) ভিক্ষু অর্থাৎ যারা সন্ন্যাস গ্রহণ করতেন । অবশেষে ৮০ বৎসর বয়সে বুদ্ধদেব কুশিনগরে আনুমানিক ৪৮৬ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে দেহ ত্যাগ করেন ।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ
বৌদ্ধ ধর্মমত জানার জন্য প্রধানত ‘ ত্রিপিটক ‘ এর উপর নির্ভর করতে হয় । ত্রিপিটক হল বিনয় পিটক , সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক । বিনয় পিটকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মঠ জীবন সম্পর্কিত নির্দেশ উল্লিখিত আছে । সূত্র পিটকে বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিক আদর্শ ও অভিধর্ম পিটকে এই ধর্মের আধ্যাত্মিক দিক আলোচিত হয়েছে । রিজডেডিস মনে করেন , বিনয় পিটকের সব বক্তব্য বুদ্ধের নয় । পরবর্তীকালে তাঁর প্রত্যক্ষ শিষ্যদের কিছু বক্তব্য এতে স্থান পেয়েছে ।
বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি
বৌদ্ধ ধর্মের মূল লক্ষ্য হল সত্যকে উপলব্ধি করা । বুদ্ধ বলেছেন , ‘ সমুদ্রের যেমন একটি মাত্র স্বাদ অর্থাৎ লবণ , আমার ধর্মেরও তেমনি একটি মাত্র স্বাদ অর্থাৎ দুঃখের হাত থেকে মুক্তি লাভ । বুদ্ধের মতে , মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় নতুন দেহে জন্মলাভ করে । জন্মলাভ করে জীবকে কর্ম করতে হয় । কর্ম থেকে আসে আসক্তি , আর আসক্তি নিয়ে আসে দুঃখ । পুনর্জন্ম গ্রহণ করে সেই দুঃখ ভোগ করতে হয় ।
কর্মফল জনিত পুনর্জন্ম রদ করে দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের একমাত্র পথ হল পরম সত্যকে জানা , অর্থাৎ ‘ নির্বাণ ’ লাভ করা । নির্বাণের জরা নেই ( অজর ) , ব্যাধি নেই ( অব্যাধি ) , মৃত্যু নেই ( অমৃত ) এবং দুঃখ কষ্ট একে স্পর্শ করতে পারে না ( অসংক্লিষ্ট ) ।
বুদ্ধ বলেছেন , মানুষের প্রয়োজন কামনা বাসনা , আসক্তি ইত্যাদি দূর করা । এজন্য মানুষকে চারটি সত্য হৃদয়ঙ্গম করার উপদেশ দিয়েছেন বুদ্ধ । এগুলি হল –
( ১ ) জীবন দুঃখময় ,
( ২ ) কামনা বাসনা , আসক্তি থেকেই দুঃখের সৃষ্টি ,
( ৩ ) কামনা বাসনার অবসানে দুঃখের অবসান ঘটে এবং
( ৪ ) কামনা বাসনার অবসানের জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করা দরকার ।
এই চারটি সত্য ‘ আর্য সত্য ‘ নামে অভিহিত হয় ।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ
বুদ্ধদেব ‘ অষ্টাঙ্গিক মার্গ ’ বলতে আটটি অবশ্য পালনীয় আচরণের কথা বলেছেন , যা করলে মানুষ ‘ নির্বাণ ‘ লাভ করবে । এগুলি হল— সৎ বাক্য , সৎ সংকলন , সৎ চিন্তা , সৎ জীবন , সৎ চেষ্টা , সৎ ব্যবহার , সৎ দর্শন এবং সম্যক সমাধি ।
বুদ্ধ নির্দেশিত এই কর্মগুলির মধ্যে যেমন চরম ভোগের প্রকাশ ছিল না , তেমনি ছিল না কঠোর কৃচ্ছ্বসাধন । তাই এগুলি ‘ মধ্যপন্থা ‘ নামে অভিহিত হয়েছে ।
বুদ্ধ তাঁর অনুগামীদের একটি আচরণ বিধি পালনের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন , এগুলি হল , চুরি না করা , ব্যভিচারী না হওয়া , অসত্য পরিহার করা , হিংসা না করা ও অন্যায় না করা । এই পাঁচটি কর্তব্য ‘ পঞ্চশীল ‘ নামে পরিচিত ।
বৌদ্ধ ধর্মের বৈশিষ্ট্য
অনেক পণ্ডিতের মতে , বৌদ্ধ ধর্ম মূলত কোন নতুন ধর্মমত নয় । এঁদের মতে , গৌতম বুদ্ধ পবিত্র জীবন যাপনের জন্য কয়েকটি শর্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন । ভি. স্মিথ বলেছেন , “ তথাকথিত অর্থে ধর্ম প্রচার বুদ্ধ করছেন তা বলা সম্মত নয় । ”
জে. এন. সরকার এর মতে , বুদ্ধদেব মৌলিক হিন্দু ধর্মকে সহজ সরল রূপে পুনঃপ্রচার করেছেন মাত্র । প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধের শিক্ষা ছিল ” আংশিক সংস্কারমূলক ও উদ্ভাবনামূলক ” ( party a reform and partly an innovation ) ।
বুদ্ধ যে সকল বাণী উপদেশ দিয়েছেন , তা প্রায় সকল ধর্মেরই মূল মন্ত্র ছিল । তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষ রূপেই বর্ণনা করেছেন । কোন রকম ঐশ্বরিক ক্ষমতার দাবি তিনি করেন নি । সৎ জীবন যাপন , হিংসা না করা বা সত্য কথা বলা’র মত অতি প্রচলিত নৈতিক কর্তব্যগুলিই তাঁর কণ্ঠে পুনধ্বনিত হয়েছিল । প্রভেদ এই যে বুদ্ধের বাণী খুব সহজে এবং খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল ।
এমনকি বৌদ্ধ ধর্মে যে সংঘ জীবনের কথা বলা হয়েছে , তাও নতুন নয় । বহু প্রাচীনকালে মুনি ঋষিরাও আশ্রম জীবনের কথা বলে গিয়েছেন । কেউ কেউ বুদ্ধদেবের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন । দীর্ঘ নিকায় বলা হয়েছে , ‘ দারিদ্র্য ও দুর্নীতিই অপরাধের কারণ । তাই অপরাধ নিবারণের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে কৃষক , শ্রমিক ও বণিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া বিধেয় । ‘
অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় প্রাচীনকালে গ্রীকদের দেহ-সৌষ্ঠব গঠনে শরীর চর্চা প্রণালীর ( Gymnastics ) যে স্থান , বৌদ্ধ ধর্মে অষ্টাঙ্গিক মার্গের তাই । ‘ সমাজে নারীকে স্ব-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বুদ্ধ ছিলেন খুব সচেতন । নারী গৃহকোণ ছেড়ে সমাজের কাজে অংশগ্রহণ করবে , পুরুষের সমমর্যাদা লাভ করবে , এই ছিল বুদ্ধের নির্দেশ ।
এমনকি সমাজের চোখে ঘৃণ্য বারবণিতাদের প্রতিও তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল । এইসব কারণে বুদ্ধের ধর্মমতকে ধর্মীয় বিবর্তন না বলে সামাজিক বিবর্তন বলাই বিধেয় ।