শিক্ষা সংস্কারক রূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
Contents
শিক্ষা সংস্কারক রূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসে বিশেষত শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে স্বদেশবাসীকে শিক্ষিত ও জ্ঞানের আলােয় আলােকিত করতে বিদ্যাসাগর সনাতন শিক্ষার সঙ্গে যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন । বিদ্যাসাগর শিক্ষাকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম বলে মানতেন না । তার কাছে শিক্ষা ছিল মনুষ্যত্বে উত্তরণের সিঁড়ি । শিক্ষাবিস্তারে বিদ্যাসাগরের কীর্তিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন — “ যারা অতীতের বড়াে বাঁধা লঙ্ঘন করে দেশের চিত্তকে ভবিষ্যতের পরম সার্থকতার দিকে বহন করে নিয়ে যাবার সারথিস্বরূপ , বিদ্যাসাগর তাদের অগ্রগণ্য । ”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষা ভাবনা
বিদ্যাসাগর শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাচ্য – পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন । শিক্ষা বিষয়ক এক প্রস্তাবে তিনি লিখেছিলেন — “ আমার উদ্দেশ্য হল সংস্কৃত ও ইংরেজি সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডারকে একত্রিত করে তার ভিত্তিতে শিক্ষার প্রসার ঘটানাে । ” কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন , “ আমি আর যতদিন বাঁচবাে সেই সময়টা দেশের ছেলেমেয়েরা যাতে লেখাপড়া শিখে মানুষ হয় তার জন্য চেষ্টা করবাে , আর আমার সেই ব্রত আমার মৃত্যুর পরে আমার শ্মশানের ছাইয়ে মিশে সার্থক হবে । ”
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্ত্রী শিক্ষার প্রসার
শিক্ষার অভাবে নারীজাতি পিছিয়ে রয়েছে , শিক্ষা ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নেই বলে বিদ্যাসাগর মনে করতেন । নারী শিক্ষার পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের সাহায্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮৪৯ খ্রি. ) হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় ( এখনকার বেথুন স্কুল ) । তিনি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বাংলার বিভিন্ন জেলায় ( হুগলিতে ২৩টি , বর্ধমানে ১১টি , মেদিনীপুরে ৩টি , নদিয়ায় ১টি ) মােট ৩৮টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন , যেগুলিতে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশুনার সুযােগ পেয়েছিল । তিনি মায়ের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশে নিজের জন্মস্থানে বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮৯০ খ্রি . ) । তিনি নারীকে শিক্ষিত করে তাদেরকে সম্মানের আসনে বসাতে চেয়েছিলেন । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন — “ যেখানে নারীরা সম্মানিত হয় , সেখানে ভগবান বাস করে ”।
উচ্চ শিক্ষার সুযােগ বৃদ্ধি
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদ গ্রহণ ( ১৮৫০ খ্রি. ডিসেম্বর ) করার পর দেখেন যে এই কলেজে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য শ্রেণিভুক্ত ছাত্ররাই পড়ার সুযােগ পেত । তাই এই কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে ( ১৮৫১ খ্রি. ২২ জানুয়ারি ) প্রথমেই তিনি সংস্কৃত কলেজের দরজা সব বর্ণের হিন্দু ছাত্রদের জন্য খুলে দেন । উচ্চশিক্ষার সুযােগ বাড়ানাের লক্ষ্যে তিনি নিজের খরচে প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮৭০ খ্রি. ) মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন ( এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ ) । এ ছাড়াও তিনি হিন্দু পঞ্জিকা নির্দেশিত তিথি – নক্ষত্র মেনে ছুটি দেওয়ার রীতি বাতিল করে রবিবারকে ছুটির দিন হিসেবে ধার্য করেন ও কলেজে অধ্যাপকদের নিয়মিত আসার নিয়ম চালু করেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আধুনিক পাঠক্রম প্রণয়ন
বিদ্যাসাগর সে সময়ে একজন শিক্ষকরূপে উপলদ্ধি করেছিলেন যে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পুস্তকের অভাব রয়েছে । তাই তিনি ‘ বর্ণমালা ’ , ‘ কথামালা ’ , ‘ বােধােদয় ’ পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন । কলেজের শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার কয়েকমাসের মধ্যেই বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেরেস্তাদারের ( প্রধান পণ্ডিত ) পদে কাজ শুরু করেন ( ১৮৪১ খ্রি. ২৯ ডিসেম্বর ) । প্রায় পাঁচ বছর এখানে কাজ করার পর তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পদে যােগ দেন । বিদ্যাসাগর শিক্ষকরূপে বিদ্যালয়গুলির পাঠক্রম পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে পাটিগণিত , জ্যামিতি , নীতিবিজ্ঞান , রাষ্ট্রবিজ্ঞান , শারীরবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন ।
বিদ্যালয় পরিদর্শক
বড়োলাট লর্ড ডালহৌসি ও ছােটোলাট হ্যালিডের অনুমােদনের ফলশ্রুতিরূপে হুগলি , মেদিনীপুর , বর্ধমান ও নদিয়া জেলায় ‘ Circle School ’ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে বিদ্যাসাগর মাসিক পাঁচশত টাকা বেতনের বিনিময়ে দক্ষিণ বাংলার ওই চার জেলায় বিদ্যালয় পরিদর্শকরুপে নিযুক্ত হন । এই পদে থাকাকালীন তাঁর প্রচেষ্টায় চারটি জেলায় ৫টি করে মােট ২০টি বাংলা স্কুল স্থাপিত হয় । বিদ্যালয় পরিদর্শকরূপে বিদ্যাসাগর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিবিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলিতে একজন প্রধান পণ্ডিত এবং দুজন সহকারী পণ্ডিতের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিচালনার পরিকল্পনা নেন । এ সময়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে ৫টি মডেল স্কুলের ( নদিয়া , বর্ধমান , হুগলি , মেদিনীপুর ) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সংস্কৃত কলেজের মধ্যে একটি নর্মাল স্কুল ( ১৮৫৫ খ্রি. ১৭ জুলাই ) গড়ে ওঠে । এই স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব পান অক্ষয়কুমার দত্ত ও মধুসুদন বাচস্পতি ।
বাংলা গদ্যের স্রষ্টা
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত হলেও বিদ্যাসাগর এটা বুঝেছিলেন যে , বাংলা ভাষাই হল শিক্ষার গণমুখী প্রচেষ্টার প্রধান মাধ্যম । অলংকার সর্বস্ব ও সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা ভাষা বিদ্যাসাগরের হাতের ছোঁয়ায় আগের থেকে অনেক সাবলীল ও গতিশীল হয়ে ওঠে । বাংলা ভাষাকে আধুনিক রূপ দান করা ও তাতে এক নতুন শব্দবিন্যাস রীতির প্রচলন ঘটানাে বিদ্যাসাগরের অসামান্য কীর্তি । যতি চিহ্নের যুক্তিসম্মত ব্যবহার এবং বড়াে বাক্যকে কয়েকটি ছােটো বাক্যে ভেঙে ব্যবহারের রীতির তিনিই প্রচলন ঘটান । তাঁর এই রীতিকে পরবর্তী সময়ে অনুসরণ করেছিলেন মধুসুদন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই । রবীন্দ্রনাথের মতে — “ বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ”।
লেখক
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী বিদ্যাসাগর নিছক শিল্পসৃষ্টির তাগিদে সাহিত্য রচনা করেননি , তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থই জনশিক্ষার প্রয়ােজনে রচিত । ‘ বর্ণপরিচয় ’ ১ম ও ২য় ভাগ ( ১৮৫৫ খ্রি. ) , ‘ বােধােদয় ‘ ( ১৮৫১ খ্রি. ) , ‘ কথামালা ’ ( ১৮৫৬ খ্রি. ) , ‘ নীতিবােধ ’ , ‘ চরিতাবলি ’ ( ১৮৫৬ খ্রি. ) ইত্যাদি রচনার পাশাপাশি সহজে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি রচনা করেন ‘ উপক্রমণিকা ’ ( ১৮৫১ খ্রি. ) , ‘ ব্যাকরণ কৌমুদী ‘ ( ১৮৫৩ খ্রি. ) প্রভৃতি গ্রন্থ । তিনি ‘ আখ্যান মঞ্জরী ’ ( ১৮৬৩ খ্রি. ) , ‘ শব্দ মঞ্জরী ‘ ( বাংলা ভাষা অভিধান – ১৮৬৪ খ্রি. ) , ‘ শ্লোক মঞ্জরী ’ ( ১৮৯০ খ্রি. ) সংকলন করেন । তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘ অতি অল্প হইল ‘ ( ১৮৭৩ খ্রি. ) , ‘ আবার অতি অল্প হইল ‘ ( ১৮৭৩ খ্রি. ) , ‘ ব্রজবিলাস ’ ( ১৮৮৪ খ্রি. ) , ‘ রত্নপরীক্ষা ‘ ( ১৮৮৬ খ্রি. ) প্রভৃতি ।
অনুবাদক
অনুবাদকরূপে বিদ্যাসাগর অসাধারণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দেন । বিদ্যাসাগর সংস্কৃত , হিন্দি , ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ অনুবাদ করেন । হিন্দি বেতাল পচ্চিশির বঙ্গানুবাদ ‘ বেতাল পঞ্চবিংশতি ’ ( ১৮৪৭ খ্রি. ) , কালিদাস রচিত অভিজ্ঞান শকুন্তলম অনুসরণে ‘ শকুন্তলা ’ ( ১৮৫৪ খ্রি. ) , ভবভূতির উত্তর রামচরিত অবলম্বনে ‘ সীতার বনবাস ’( ১৮৬০ খ্রি. ) , শেক্সপিয়র রচিত ‘ কমেডি অব এররস ’ – এর ভাবানুবাদ ‘ ভ্রান্তিবিলাস ’ , মার্শম্যানের ‘ History of Bengal ’ গ্রন্থটির অনুবাদ ‘ বাংলার ইতিহাস ’ ছিল তাঁর উল্লেখযােগ্য অনুবাদ সাহিত্য । ঈশপের ‘ ফেবলস ’ – এর অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘ কথামালা ’। বিদ্যাসাগরের অনুবাদ গ্রন্থগুলিও মৌলিক সাহিত্যের মতােই অনন্য সৃষ্টিরুপে স্বীকৃত । মৌলিক রচনা করার ক্ষমতা থাকলেও লােকহিত সাধনের জন্যই তিনি সেই ক্ষমতাকে অনুবাদ সাহিত্য রচনার কাজে লাগিয়েছিলেন ।
সাংবাদিক
আধুনিক অর্থে সাংবাদিক বলতে যা বােঝায় বিদ্যাসাগর তা ছিলেন না । জীবনের শেষের দিকে ‘ তত্ত্ববােধিনী ’ ও ‘ সর্বশুভকরী ’ পত্রিকা দুটির সঙ্গে তাঁর সরাসরি যােগাযােগ ছিল । দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘ সােমপ্রকাশ ’ পত্রিকাটির পরিকল্পনা তিনিই করেছিলেন । হরিশচন্দ্র মুখােপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ‘ হিন্দু পেট্রিয়ট ’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন বিদ্যাসাগর । বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর বিভিন্ন ধারণা ও মতামত জানিয়েছিলেন ।
মূল্যায়ন
বিদ্যাসাগরের কথা ও কাজের মধ্যে কোনাে ফারাক ছিল না । তিনি যা বলতেন নিষ্ঠাসহকারে তা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতেন । শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর সফল প্রচেষ্টার স্বাক্ষর রেখেছেন । সংস্কৃত কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ বিদ্যাসাগর ’ উপাধিতে ভূষিত করে । ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সােসাইটি তাকে সম্মানীয় সদস্যপদে মনােনীত ( ১৮৬৪ খ্রি. ) করে । অরবিন্দ ঘােষ শিক্ষা সংস্কারক বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন — “ একটি নতুন বাংলা ভাষা ও বাঙালি সমাজ গঠনের লক্ষ্যে পণ্ডিত , সাধক ও শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বিদ্যাসাগর এক শক্তিশালী দানবের মতাে পরিশ্রম করে গেছেন ” ( Vidyasagar , scholar , sage and intellectual dictator , laboured hugely like the titan he was , to create a new Bengali language and a new Bengali Society ) ।