উনিশ শতকের নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
Contents
উনিশ শতকের নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
আধুনিক ভারতের নির্মাতারপে ‘ ভারতপথিক ’ রাজা রামমােহন রায় যে সংস্কারমুখী কাজগুলি করে গেছেন , তার ওপর ভিত্তি করেই ভারতবর্ষ আধুনিক রূপ পেয়েছে । তাই তাকে ‘ ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত ’ বলা হয়েছে । রামমােহন রায় একাধারে ছিলেন একজন সমাজ – শিক্ষা – ধর্ম সংস্কারক , নারীকল্যাণ ব্রতী , সাহিত্যিক ও সাংবাদিক । রবীন্দ্রনাথের মতে — “ রামমােহন তাঁর সময়ে বিশ্বের সমস্ত মানুষের মধ্যে ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি , যিনি সম্পূর্ণভাবে আধুনিক যুগের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন ” ( Rammohan was the only person in his time , In the whole world of man to realise completely the significance of the Modern Age ) ।

সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
সতীদাহ প্রথার অবসান :
তৎকালীন হিন্দুসমাজে মৃত স্বামীর চিতায় তার স্ত্রীকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত । আসলে মৃত কুলীন ব্যক্তিকে বহু বিধবার দায় থেকে মুক্তি , মৃতার সম্পত্তি গ্রাসের ইচ্ছা ও অন্যান্য সামাজিক জটিলতা এড়ানাের লক্ষ্যে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে এই জঘন্য সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল । এই প্রথাটি বন্ধ করার জন্য রামমােহন সেসময়কার বাংলার ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র তৎকালীন বড়োলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে পাঠান । বেন্টিঙ্ক রামমােহনের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৭নং রেগুলেশন ( Regulation – XVII ) জারি করে সতীদাহ প্রথাকে বেআইনি বলে ঘােষণা করেন । বলা হয় যে , এই প্রথা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযােগ্য অপরাধরূপে গণ্য হবে ( ১৮২৯ খ্রি. ৪ ডিসেম্বর ) ।
জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা :
রামমােহন হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরােধী ছিলেন । তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরার জন্য ‘ বজ্ৰসূচি ’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন । তিনি অসবর্ণ বিবাহের সমর্থনেও কলম ধরেন । তবে সমালােচকদের মতে , জাতিভেদ প্রথার বিরােধী হয়েও তিনি উপবীত ধারণ করতেন । এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুশােভন সরকার বলেছেন — “ হিন্দু সমাজে পতিত হওয়ার ভয়ে রামমােহন উপবীত ত্যাগের সাহস দেখাননি ”।
নারী কল্যাণ প্রচেষ্টা :
রামমােহন প্রথম অনুভব করেছিলেন যে সমাজে নারীদের অবস্থানের উন্নয়ন ঘটানাে এবং তাদের মর্যাদা বাড়ানাে দরকার । তিনি মূলত যেসব নারী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন সেগুলি হল —
- স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা । তিনি যাজ্ঞবল্ক্য , কাত্যায়ন , ব্যাস প্রমুখ শাস্ত্রকারদের শাস্ত্রবিধান তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে , পিতার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার রয়েছে ।
- স্ত্রীশিক্ষার সার্বিক প্রসার । কারণ তিনি মনে করতেন নারীসমাজকে শিক্ষার আলােয় নিয়ে আসতে না পারলে সমাজের প্রগতি ও সভ্যতার উন্নতি রুদ্ধ হয়ে যাবে ।
- কৌলীন্য প্রথার শিকার নারীসমাজকে রক্ষা করা ।
- বিবাহ বিষয়ক এক নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা ।
ধর্ম সংস্কারে ভূমিকা :
রামমােহন দেখেছিলেন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে ধর্ম ওতপ্রােতভাবে জড়িত । হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধন করাই ছিল তাঁর প্রথম প্রয়াস ।
একেশ্বরবাদের প্রচার :
মূর্তি পূজার ঘাের বিরােধী ছিলেন বলেই তিনি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন । এই কারণে হিন্দুধর্মের প্রকৃত স্বরূপ ও ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করে তার বিশুদ্ধ রূপটি তিনি সকলের সামনে তুলে ধরেন ।
কুসংস্কারের বিরােধিতা :
ধর্মীয় ক্ষেত্রে রামমােহন এক যুক্তিবাদী মন নিয়ে চিন্তার স্বচ্ছতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা ধর্মীয় কুসংস্কারগলি দূর করার উদ্যোগ নেন । ইংল্যান্ডে অতিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলিতে তিনি ইউনিটারিয়ান খ্রিস্টধর্মের অনুরাগী হয়ে ওঠেন ।
শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক :
প্রাচ্য দর্শনকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য শিক্ষাকে ভারতের পুনর্জাগরণের উপায় বলে রামমােহন মনে করতেন । তাই তিনি নিজে সংস্কৃত সাহিত্য , জৈন ধর্ম , হিন্দু দর্শন , আরবি , ফারসি ও কোরানের মূল শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি ইংরেজি , ফরাসি , লাতিন , হিব্রু ও গ্রিক ভাষায় পণ্ডিত্য অর্জন করেন । তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতবাসীকে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক মনের অধিকারী করে তুলবে ।
স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা :
রামমােহন শিক্ষার সার্বিক প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্কুল , কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন । এই লক্ষ্যে তিনি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ( ১৮১৭ খ্রি. ) সাহায্য করেন । এ ছাড়াও তিনি একটি বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আলেকজান্ডার ডাফ – এর সহযােগিতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন । তিনি নিজের প্রচেষ্টায় অ্যাংলাে হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ।
সংবাদপত্র প্রকাশনা :
রামমােহন সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের দিশারি ছিলেন । তিনি বাংলা , ইংরেজি , হিন্দি ও ফারসি ভাষায় বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন । বাংলা ভাষায় সম্বাদ কৌমদী । ( ১৮২১ খ্রি. ) এবং ফারসিতে প্রকাশিত মিরাৎ – উল – আখবর ( ১৮২২ খ্রি. ) ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযােগ্য সংবাদপত্রের নিদর্শন । ড. বিপান চন্দ্রের মতে — “ রামমােহন ভারতের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও একজন অগ্রদূতের ভূমিকা নিয়েছিলেন ” ( Rammohan Roy was a pioneer of Indian Journalism ) ।
রাজা রামমোহন রায়ের অর্থনৈতিক চিন্তা
রামমােহনের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় মেলে সিলেক্ট কমিটির নির্ধারিত আর্থিক সমস্যার সমাধানকল্পে তাঁর অভিমত থেকে । ব্রিটিশের ভূমিরাজস্ব নীতি প্রসঙ্গে রামমােহন বলেন — “ রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের তুলনায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অধিক শ্রেয় ”। ব্রিটিশ প্রশাসনের ব্যয় সংকোচের প্রশ্নে রামমােহনের অভিমত ছিল অধিক বেতনের ইউরােপীয় কর্মচারীর পরিবর্তে ভারতীয় কালেক্টর নিয়ােগ অধিক উপযােগী । রামমােহন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া কারবারের বিরােধিতা করলেও অবাধ বাণিজ্য নীতিকে সমর্থন করেন । এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল — অবাধ বাণিজ্য নীতির সূত্রে ভারতে ব্যাপকভাবে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটবে , তার সুফল হিসেবে ভারতবাসীর আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে । রামমােহন সম্পদের নির্গমনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলেও তিনি অবশিল্পায়নের প্রশ্নে নীরব ছিলেন ।
রাজা রামমোহন রায়ের রাজনৈতিক সংস্কারে ভূমিকা
রামমােহনের রাজনৈতিক ভাবনা মন্টেস্কু , রুশাে , ভলতেয়ার , টম – পেইন , বেনথাম প্রমুখের চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । তিনি মনে করতেন ভারতীয়দের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটানাের জন্য ভারতবর্ষের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে তুলে দেওয়াই শ্রেয় । রামমােহন সাংবিধানিক নিয়ম মেনে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে শাসনতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন ।
সমকালীন ইউরােপের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় রামমােহনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় । যেমন ইতালির রাজতন্ত্র বিরােধী অভ্যুত্থানের ( ১৮২১ খ্রি. ) ব্যথর্তায় তিনি হতাশ হন , অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় স্পেন বিরােধী বিদ্রোহের ( ১৮২৩ খ্রি. ) সফলতা এবং ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে তিনি উৎফুল্ল হন ।
মূল্যায়ন
উনিশ শতকের সংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ , সামাজিক উন্নয়ন ও শিক্ষার উদারীকরণের ক্ষেত্রে রামমােহন ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অগ্রদূত স্বরুপ । স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা অনেকের থেকে বেশি ছিল । রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ও ঔপনিবিেশক শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামাের মধ্যে থেকেও রামমােহন ভারতকে আধুনিকরূপে গড়ে তােলার চেষ্টা করেছিলেন , এখানেই তাঁর বড়াে কৃতিত্ব । রামমােহনের মৃত্যু শতবর্ষে ( ১৯৩৩ খ্রি. ১৮ ফেব্রুয়ারি ) রবীন্দ্রনাথ এক ইংরেজি প্রবন্ধে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে লিখেছিলেন “ রামমােহন ভারতে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটিয়েছিলেন ” ( Rammohan Roy inaugurated the Modern age in India ) ।