বাষ্পীভবন/বাষ্পায়ন/স্ফুটন কাকে বলে
Contents
বাষ্পীভবন/বাষ্পায়ন/স্ফুটন কাকে বলে
তরল পদার্থের বাষ্পে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাষ্পীভবন বলে । এই বাস্পীভবন দুটি পদ্ধতিতে হতে পারে —
- বাষ্পায়ন ( evaporation ) এবং
- স্ফুটন ( boiling ) ।

বাষ্পায়ন ( evaporation )
যে কোনাে উষ্ণতায় তরলের শুধুমাত্র উপরতল থেকে ধীরে ধীরে বাষ্পে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাষ্পায়ন বলে । পুকুর ও নদীনালার জল শুকিয়ে যাওয়া , ভিজে কাপড় রােদে শুকানাে প্রভৃতি জলের বাষ্পায়নের জন্য হয় । বাষ্পায়নের হার নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর নির্ভর করে ।
- তরলের উপরতলের ক্ষেত্রফল — তরলের উপরতলের ক্ষেত্রফল বাড়লে বাষ্পায়নের হার বাড়ে ।
- তরলের প্রকৃতি — যে সব তরলের স্ফুটনাঙ্ক ঘরের উষ্ণতার কাছাকাছি বা তার কম সেগুলির বাষ্পায়নের হার বেশি । আর যে সব তরলের স্ফুটনাঙ্ক বেশি তাদের বাষ্পায়নের হার কম ।
- বায়ুতে বাষ্পের পরিমাণ — যে কোনাে তরলের উপর ওই তরলের বাষ্পের পরিমাণ কম থাকলে বাষ্পায়নের হার বেশি হয় । যেমন — বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম হলে জলের বাষ্পায়ন দ্রুত হয় । তাই বর্ষাকাল অপেক্ষা শীতকালে ভিজে কাপড় তাড়াতাড়ি শুকায় ।
- বায়ু চলাচল — তরলের উপর দিয়ে বায়ুপ্রবাহ বাড়লে বাষ্পায়ন দ্রুত হয় ।
- তরলের উষ্ণতা — তরলের উষ্ণতা বাড়লে বাষ্পায়নের হার বাড়ে ।
- তরলের উপর চাপ — তরলের উপর চাপ কমলে বাষ্পায়নের হার বেশি হয় ।
স্ফুটন ( boiling )
কোনাে তরলকে উত্তপ্ত করলে দেখা যায় যে নির্দিষ্ট চাপে একটি নির্দিষ্ট উষ্ণতায় তরলের সমস্ত অংশ থেকে দ্রুত বাষ্পায়ন হয় । যতক্ষণ পর্যন্ত না সমস্ত তরল বাষ্পীভূত হয় ততক্ষণ তরলের উষ্ণতা স্থির থাকে । বাষ্পীভবনের এই প্রক্রিয়াকে স্ফুটন বলে । এবং এই নির্দিষ্ট উষ্ণতাকে তরলের স্ফুটনাঙ্ক বলে । দেখা যায় যে স্ফুটনের সময় তরল – বাষ্পের চাপ বায়ুমণ্ডলের চাপের সমান হয় । সুতরাং বলা যায় , যে উষ্ণতায় তরল বাষ্পের চাপ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের সমান হয় তাকে ওই তরলের স্ফুটনাঙ্ক বলে ।
তরলের স্ফুটনাঙ্ক তরলের প্রকৃতি , তরলের উপর চাপ , তরলে দ্রবীভূত অপদ্রব্যের উপস্থিতি প্রভৃতি বিষয়ের উপর নির্ভর করে ।
তরলের স্ফুটনাংকের উপর চাপের প্রভাব
স্ফুটনের ফলে তরল বাষ্পে পরিণত হলে তার আয়তন বাড়ে । সুতরাং চাপ বাড়ালে স্ফুটন ক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং চাপ কমালে স্ফুটন ক্রিয়াকে সাহায্য করা হয় । তাই তরলের উপর চাপ কমালে স্ফুটনাঙ্ক কমে এবং চাপ বাড়ালে স্ফুটনাঙ্ক বাড়ে । চাপ কমলে স্ফুটনাঙ্ক কমে তা ফ্রাঙ্কলিনের পরীক্ষা থেকে দেখানাে যায় । একটি কাচের ফ্লাস্ক অর্ধেক জল ভর্তি করে বার্নারের সাহায্যে ফোটানাে হল । এরপর বার্নার থেকে সরিয়ে নিয়ে ফ্লাস্কের মুখ থার্মোমিটার সমেত একটি কর্ক দিয়ে আটকে দেওয়া হল । কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে যে স্ফুটন বন্ধ হয়ে গিয়েছে । এবার ফ্লাস্কটি উল্টে ক্ল্যাম্পের সাহায্যে আটকানাে হল । এখন ফ্লাস্কের উপর বরফগলা ঠান্ডা জল ঢাললে দেখা যাবে যে জল আবার ফুটতে শুরু করেছে , যদিও থার্মোমিটারের পাঠ 100°C – এর কম । উল্টানাে অবস্থায় ফ্লাস্কের মধ্যস্থিত জলীয় বাষ্পের কিছু অংশ ঠান্ডা জলের প্রভাবে ঘনীভূত হয়ে জলে পরিণত হয় । ফলে জলের উপর চাপ কমে যায় এবং জল কম উষ্ণতাতেই ফুটতে শুরু করে ।
শূন্যস্থানে নিয়ে গেলে তরল যে কোনাে উষ্ণতায় ফুটতে পারে । চাপ কমালে তরলের স্ফুটনাঙ্ক কমে এই ধর্মকে ঘনীভূত দুধ তৈরি , চিনির দ্রবণ থেকে চিনির কেলাস তৈরি , হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ঘন দ্রবণ তৈরি প্রভৃতি কাজে লাগানাে হয় ।
তরলের উপর চাপ বাড়লে তরলের স্ফুটনাঙ্ক বেড়ে যায় । দেখা যায় যে চাপের পরিবর্তন 27 মিমি পারদস্তম্ভ হলে জলের স্ফুটনাঙ্কের পরিবর্তন 1°C হয় । রান্নার পাত্রে ঢাকনা চাপিয়ে রাখলে পাত্রের ভিতরের চাপ বায়ুমণ্ডলীর চাপের থেকে বেশি হয় । এর ফলে পাত্রের জল 100°C অপেক্ষা বেশি উষ্ণতায় ফোটে এবং খাদ্যদ্রব্য বেশ তাড়াতাড়ি সুসিদ্ধ হয় । এই নীতি কাজে লাগিয়ে প্রেসার কুকার তৈরি করা হয়েছে ।
প্রেসার কুকারে রান্না তাড়াতাড়ি হয় কেন
প্রসার কুকার হল অ্যালুমিনিয়াম বা স্টেনলেস স্টিলের তৈরি একটি মজবুত পাত্র । একই উপাদানে তৈরি একটি ঢাকনা রবার প্যাডের সাহায্যে পাত্রের মুখে বায়ুনিরুদ্ধভাবে আটকানাে যায় । পাত্রে জল নিয়ে উত্তপ্ত করলে যে জলীয় বাষ্প উৎপন্ন হয় তা বেরােতে পারে না , পাত্রের ভিতরে জমা হতে থাকে । এর ফলে পাত্রের ভিতর বাষ্পচাপ বাড়ে এবং ভিতরের জলের স্ফুটনাঙ্ক বাড়ে । এই উচ্চ উষ্ণতায় খাদ্যদ্রব্য খুব তাড়াতাড়ি সুসিদ্ধ হয় । পাত্রের ভিতরে চাপ খুব বেশি হলে পাত্র ফেটে যেতে পারে । তাই পাত্র যন্ত্রটির ঢাকনায় একটি পিন ভালভ লাগানাে থাকে । ভিতরে চাপ অতিরিক্ত হলে এই পিন ভালভ ঠেলে কিছুটা বাষ্প বেরিয়ে যায় । যন্ত্রের ভিতর জলের স্ফুটনাঙ্ক প্রায় 120°C পর্যন্ত হয় । পাহাড়ি এলাকায় উচ্চতার জন্য বায়ুর চাপ কম হয় ও জল 100°C – এর কম উষ্ণতায় ফোটে । ফলে এইসব জায়গায় খাদ্যদ্রব্য সহজে সিদ্ধ হয় না বলে রান্নার কাজে প্রেসার কুকার বেশি ব্যবহার করা হয় ।
চাপ বাড়লে তরলের স্ফুটনাঙ্ক বাড়ে — এই ধর্মকে প্রেসার কুকার ছাড়াও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয় । যেমন — অপারেশনের যন্ত্রপাতি , ব্যান্ডেজ প্রভৃতি জীবাণুমুক্ত করা , কাগজের মণ্ড তৈরি , কৃত্রিম সিল্ক প্রস্তুতি , হাড় থেকে জিলেটিন নিষ্কাশন করা প্রভৃতি ।
তরলের স্ফুটনাংকের উপর অপদ্রব্য প্রভাব
তরলের মধ্যে কোনাে কঠিন অপদ্রব্য দ্রবীভূত থাকলে তরলের স্ফুটনাঙ্ক বেড়ে যায় । যেমন — প্রমাণ চাপে বিশুদ্ধ জলের স্ফুটনাঙ্ক 100°C কিন্তু লবণগােলা জলের স্ফুটনাঙ্ক প্রায় 109°C । দ্রবণ থেকে নির্গত বাষ্পের উষ্ণতা কিন্তু বিশুদ্ধ তরলের স্ফুটনাঙ্কের সমান হয় । তাই তরলের স্ফুটনাঙ্ক নির্ণয়ের সময় থার্মোমিটারের বালবকে তরলে না ডুবিয়ে বাষ্পের মধ্যে রাখা হয় ।