ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের কার্যকলাপ ও অবদান
Contents
ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের কার্যকলাপ ও অবদান
ঊনবিংশ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পুরােধা তথা পথিকৃৎ ছিল ব্রাহ্মসমাজ । একেশ্বরবাদের প্রচার চালিয়ে ব্রাহ্মসমাজ উনিশ শতকের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা ঘটায় । রামমােহন রায়ের উদ্যোগে গঠিত ব্রাহ্মসভা , দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত আদি ব্রাহ্মসমাজ , কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ , শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমােহন বসু প্রতিষ্ঠিত সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ — সবগুলিই ছিল ব্রাহ্ম আন্দোলনের শরিক ।

ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা
রামমােহন উপনিষদকে ভিত্তি করে ব্রাহ্মসভা নামক যে একেশ্বরবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করেন , তা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিতি পায় । এই ধর্মসংঘটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের উপাসনা করা । ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা পৌত্তলিকতাবাদের বিরােধী ও একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা বেদ , উপনিষদ , পুরাণ অনুসারে হিন্দু আচার অনুষ্ঠানের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন ।
ব্রাহ্মসমাজের বিবর্তন ও কার্যকলাপ
আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে :
১৮৩৩ খ্রি. রামমােহন রায় মারা যাবার পর ব্রাহ্ম আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে । দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের প্রচেষ্টায় কোনােরকমে ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকে । রামমােহনের মৃত্যুর প্রায় ৭ বছর পর দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করলে ব্রাহ্ম আন্দোলন পুনরায় গতিশীল হয়ে ওঠে । দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজ এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে ওঠে । তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় নিয়মকানুন , আচার – আচরণ ও দীক্ষাদান রীতির প্রবর্তন ঘটিয়ে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে এক সুসংগঠিত ধর্মীয় রূপ দান করেন । তিনি ‘ ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি ’ নামে এক গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ব্রাহ্ম অনুরাগীদের সুশৃঙ্খলরূপে গড়ে তােলার প্রচেষ্টা নেন । তিনি এক সভার আয়ােজন করে রামমােহন নির্দেশিত বেদান্ত প্রতিপাদ্য ‘ সত্যধর্ম ’ নামের পরিবর্তে ‘ ব্রাহ্মধর্ম ‘ নামের উদ্যোগ নেন । এ প্রসঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন — “ পূর্বে ব্রাহ্মসমাজ ছিল , এখন ব্রাহ্মধর্ম রইল । ”
ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে :
১৮৫৭ খ্রি. কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যােগদান করলে ব্রাহ্মধর্মীয় আন্দোলন আরও গতিশীল হয়ে ওঠে । কেশবচন্দ্র ব্রহ্ম উপাসনা পদ্ধতিকে ও ব্রাহ্মধর্মের মূলতত্ত্বগুলিকে আরও সহজ সরলভাবে উপস্থাপিত করে সেগুলিকে যুগ ও সমাজের উপযােগী করে তােলেন । কিন্তু কেশবচন্দ্রের প্রগতিশীল মনােভাবে দেবেন্দ্রনাথের সায় না থাকায় কেশবচন্দ্র তার অনুগামীদের নিয়ে ব্রাহ্মসমাজ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ‘ ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ‘ প্রতিষ্ঠা করেন ( ১৮৬৬ খি. ১১ নভেম্বর ) । ফলে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ ‘ আদি ব্রাহ্মসমাজ ’ নামে পরিচিতি পায় । কেশবচন্দ্রের নব প্রতিষ্ঠিত ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ধর্মসংস্কারের মূলধারা থেকে সরে গিয়ে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হয় । ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ উপাসনা হিসেবে বৈষ্ণব সংকীর্তন নীতিকে গ্রহণ করে । কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ব্রাহ্মধর্ম ‘ সর্ব ধর্ম সমন্বয়কারী নববিধান ’ হিসেবে ঘােষিত হয় ( ১৮৮০ খ্রি. ) । কেশবচন্দ্র বৈষ্ণবদের ভক্তিবাদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের ঈশ্বরপ্রেমের সমন্বয় ঘটান । তাঁর নেতৃত্বে উপবীত বর্জন প্রথা চালু হয় । কেশবচন্দ্রের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার জন্যই ব্রাহ্ম আন্দোলন সর্বভারতীয় স্তরে ছড়িয়ে পড়ে ।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে :
অচিরেই ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে অন্তর্বিরােধের সূচনা ঘটে । তরুণ যুক্তিবাদী প্রগতিশীল সদস্যেরা সমাজ ও ব্রহ্মমন্দিরগুলির পরিচালনার জন্য সংবিধান রচনার দাবি জানালে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংঘের নেতা নির্বাচনের দাবি তুললে কেশবচন্দ্রের সঙ্গে মতবিরােধ ঘটে । অবশেষে নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট – এর বিধি ভেঙে কেশবচন্দ্র কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে নিজের ১৪ বছর বয়সি কন্যা সুনিতীর হিন্দু মতে বিবাহ দিলে প্রগতিশীল তরুণ নেতারা ব্রাহ্মসমাজ ছেড়ে বেরিয়ে যান । শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমােহন বসুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ’ ( ১৮৮১ খ্রি. জানুয়ারি ) । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টার ফলে ব্রাহ্মধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন অনেকটাই প্রগতিশীল ও উদার হয়ে ওঠে ।
ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের অবদান
ভারতের ধর্মীয় ক্ষেত্রে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে ।
ধর্মীয় অনাচারের অবসান :
সে সময়কার ভারতবর্ষের ধর্মীয় ক্ষেত্রে মূর্তিপূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের আচার অনুষ্ঠানগুলি অনাচারের রূপ নেয় । প্রথমে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , পরে কেশবচন্দ্রের প্রচেষ্টায় ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনাচারের অনেকটাই অবসান ঘটে।
মূর্তি পূজার বিরােধিতা :
রামমােহনের হাত ধরে যে পৌত্তলিকতাবাদ বিরােধী ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাকে অক্ষুন্ন রেখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , কেশবচন্দ্র সেন , শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমােহন বসু প্রমুখ ।
সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ স্থাপন :
ব্রাহ্মধর্মে সর্বধর্মসমন্বয়বাদের আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল । রামমােহনের একেশ্বরবাদী ধর্মচেতনার সঙ্গে ইসলামীয় ও খ্রিস্টীয় ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ ঘটেছিল । দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুধর্ম থেকে কোনাে আলাদা ধর্ম ছিল না । আর কেশবচন্দ্র মনে করতেন , ব্রাহ্মধর্ম হল একটি সর্বজনীন ধর্ম । যেখানে সকল জাতির ও সকল ধর্মের মানুষের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে ।
মূল্যায়ন
ব্রাহ্মধর্মের ওপর নব্য হিন্দু আন্দোলনের প্রভাব পড়লে ব্রাহ্ম আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পডে । ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সভা গড়ে ওঠায় হরিসভা ও সনাতন ধর্মসভার প্রসারলাভ সম্ভব হয় । ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ধর্মীয় ক্ষেত্রের পাশাপাশি সামগ্রিকরুপে জাতীয় জাগরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে , “ কেশবচন্দ্র পরিচালিত এই ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনই হল প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন ।”