জাতীয়তাবাদের বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান
Contents
জাতীয়তাবাদের বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান
পরাধীন ভারতবর্ষে স্বদেশবাসীকে সর্বপ্রথম আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তােলার কাজে সফল হয়েছিলেন যিনি , মৃতপ্রায় একটি জাতির দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন যিনি , তিনি হলেন শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের প্রিয়তম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ । স্বামীজির জাতীয়তাবাদী আদর্শ , স্বদেশ চেতনা ও দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্ম । এই কর্মযােগী বীরের উদাত্ত আহ্বানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত আপামর ভারতবাসী তাদের হারিয়ে যাওয়া চেতনা ফিরে পেয়েছিল । অরবিন্দের মতে — বিবেকানন্দই আমাদের জাতীয় জীবনের গঠন কর্তা ও প্রধান নেতা । নবভারতের অন্যতম রূপকার স্বামীজির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন — ভারতবর্ষকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে পড়তে ও জানতে হবে ( ‘ If you want to know India read Vivekananda ‘ ) ।
স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদী আদর্শ
দেশবাসীর উদ্দেশে স্বামীজির মহাজাগরণের বাণীগুলি জাতীয়তাবাদের বােধন ঘটিয়েছিল । পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করার জন্য স্বামীজি যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান । পুণ্যভূমি ভারতকে তিনি জীবনের একমাত্র সত্য বলে মনে করতেন । এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন — “ ভারতের মৃত্যু হলে সত্যের মৃত্যু ঘটবে ” । তিনি বলেন — আগামী ৫০ বছরের জন্য ভারত – মাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা । অন্যান্য অকেজো দেবতাদের ভুলে গেলে ক্ষতি নেই ।
জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত
স্বামীজি কোনােদিনই প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি বা রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না । কিন্তু তাঁর অন্তরে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ঘাটতি ছিল না । স্বামীজির জ্ঞানযােগ , রাজযােগ , বর্তমান ভারত , পরিব্রাজক প্রভৃতি গ্রন্থ ও পত্রাবলিগুলি বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস ছিল । নেতাজি তাঁর অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী ‘ ভারত পথিক ’ – এ স্বীকারােক্তি জানান — “ স্বামীজির বাণী ও রচনাবলি আমার চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল ” । গান্ধিজি বলেন — তাঁর রচনাবলি পাঠ করে মাতৃভূমির প্রতি আমার ভালােবাসা সহস্রগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি
স্বামীজির বাণীগুলিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ও উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুবসম্প্রদায় স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল রক্তে রাঙা দিনগুলিতে স্বামীজি ছিলেন বিপ্লবীদের আদর্শ । গােপাল হালদারের মতে বাংলা দেশকে যদি কেউ বিপ্লবী মন্ত্রে জাগিয়ে থাকেন , তিনি বিবেকানন্দ । বিবেকানন্দ বলেন — কেবল সাহসী শক্তিমানরাই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে ।
জাতীয়তাবাদের স্বরূপ
স্বামীজির জাতীয়তাবাদে মাতৃভূমির শৃঙ্খলমােচনের পাশাপাশি মানব মুক্তির কথা বলা হয় । স্বামীজি বলেছিলেন — “ জগতের ইতিহাস পর্যালােচনা কর , যেখানেই কোন সুমহান আদর্শের সন্ধান মিলিবে , দেখিতে পাইবে উহার জন্ম ভারতবর্ষে । ” মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতে — স্বামীজির জাতীয়তাবাদ হল অধ্যাত্ম সাম্রাজ্যবাদ । বিপিনচন্দ্র পালের মতে — স্বামীজির স্পর্শে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একটি আধ্যাত্মিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় ( ‘ The Nationalist Movement in India is essentially a spiritual movement ‘ ) ।
মূল্যায়ন
স্বামীজি দেবাত্মার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন মানবাত্মাকে । তাই তাঁর আদর্শ ও যাবতীয় ধ্যানধারণা ঘিরে ছিল স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর মুক্তি আর তার সঙ্গে বিশ্ব মানবাত্মার মােক্ষলাভ । আর. জি. প্রধানের মতে — স্বামী বিবেকানন্দকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক বলা যেতে পারে ( ‘ Swami Vivekananda might well be called the father of Indian nationalism ‘ ) । স্বামীজিকে স্মরণ করে আজও প্রতি বছর ১২ জানুয়ারি স্বামীজির জন্মদিনটি যুব দিবস রূপে পালিত হয় । বিবেকানন্দ নতুন ভারত গঠনের যে স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন তাকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে ভারতের কর্ণধাররা নতুন ভারত গঠনে প্রয়াসী হয়েছেন । তাই ফরাসি পণ্ডিত রােমা রােল্যাঁ বলেছেন — স্বামীজির সর্বজনীন আত্মা মানবাত্মায় পর্যবসিত হয়েছিল ( ‘ His universal soul was roted in its human soul ‘ ) ।