সমাজ সংস্কারক রূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
Contents
সমাজসংস্কারকরূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
বিদ্যাসাগর সারাজীবন ধরেই সমাজের বহুমুখী সংস্কারে ব্রতী ছিলেন । কুসংস্কার ও বিভিন্ন নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হিন্দুসমাজের নারীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁর প্রচেষ্টা ছিল অবিস্মরণীয় । বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরােধিতা , বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলন , নারীশিক্ষার বিস্তার , উচ্চশিক্ষার প্রসার , সর্বোপরি জাতিভেদ , অস্পৃশ্যতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধেও তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন । রবীন্দ্রনাথ কর্মবীর বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন — “ বিধাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্গভূমিকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন । ”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আন্দোলন
বিধবা বিবাহ সমর্থন :
সমাজসংস্কারক বিদ্যাসাগরের জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বিধবা বিবাহ প্রবর্তন । সে সময়কার হিন্দু সমাজে অত্যন্ত অল্প বয়সি মেয়েদের সঙ্গে বয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও বিবাহ হত । ফল স্বরূপ অনেক সময় অল্প বয় সেই মেয়েরা বিধবা হত । বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম হিন্দু বাল্য বিধবাদের বৈধব্যকালীন জীবন যন্ত্রণা অনুভব করেন । তিনি পরাশর সংহিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে , বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত । উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন ।
বিধবা বিবাহের সপক্ষে আইন পাস :
বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহকে সমর্থন জানিয়ে ৯৮৭ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র ভারতীয় আইন সভার সদস্যদের কাছে পাঠানাে হয় ( ১৮৫৫ খ্রি. ৪ অক্টোবর ) । বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় লর্ড ডালহৌসির সরকার অবশেষে ১৪নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন পাস করায় ( ১৮৫৬ খ্রি. ২৬ জুলাই ) এবং এক ঘােষণায় বলে বিধবা বিবাহজাত সন্তান পিতার সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার পাবে । বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হলে বিদ্যাসাগর বলেন — বিধবাবিবাহ প্রথা প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম ।
বিধবা বিবাহ আয়োজন :
বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখার্জির দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতি দেবীর মধ্যে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয় ( ১৮৫৬ খ্রি. ৭ ডিসেম্বর ) । এরপরে নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগর ১৮ বছরের ভবসুন্দরী নামক বিধবার বিবাহ দেন । ১৮৫৬ – ৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে তিনি নিজের ৮২ হাজার টাকা খরচ করে মােট ৬০ জন বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন । দরিদ্র বিধবাদের সাহায্য করার জন্য বিদ্যাসাগর ‘ হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড ’ ( ১৮৭২ খ্রি. ) গঠন করেন ও নিজে এর কোষাধ্যক্ষ হন । নিজ পুত্রের বিধবা বিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লিখেছিলেন — নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর বহু বিবাহের বিরোধিতা
সে সময়কার হিন্দু সমাজে বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল । জনসাধারণকে বহু বিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলির সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর দু – খণ্ডের ‘ বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব ’ নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি এই প্রথাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বর্ধমানের মহারাজা ( মহতাব চাঁদ )-র সহায়তায় ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষরিত এক প্রতিবাদপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান ( ১৮৫৫ খ্রি. ) । ব্রিটিশ সরকার বিদ্যাসাগর সহ কয়েকজনকে নিয়ে বহু বিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের জন্য এক কমিটি নিয়ােগ করে । কিন্তু মহাবিদ্রোহের পর সরকারি তরফে হিন্দু সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপে দ্বিধা থাকায় এই ব্যাপারটি খুব বেশি দূর এগােয়নি ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর বাল্য বিবাহের বিরোধিতা
তৎকালীন হিন্দু সমাজে বাল্য বিবাহ ছিল এক অভিশাপের মতাে । এই অভিশাপ মােচনের জন্য তিনি আজীবন সচেষ্ট ছিলেন । বাল্য বিবাহের বিরােধিতা করে বিদ্যাসাগর সর্বশুভকরী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘ বাল্য বিবাহের দোষ ’ নামক প্রবন্ধ লেখেন । বাল্য বিবাহের ফলে মেয়েরা খুব কম বয়সেই বিধবা হত ফলে বাকি জীবনটা তাদের বৈধব্যের গ্লানি ও বিভিন্ন কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে কাটাতে হত । এই অল্প বয়সী মেয়েদের জীবনের দুঃখ মােচনের জন্যই বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন । বিদ্যাসাগর বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে যেভাবে সােচ্চার হয়েছিলেন তার ফলশ্রুতিরূপে ব্রিটিশ সরকার এক আইন পাস ( ১৮৬০ খি. ) – করে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১০ বছর ধার্য করে । এ প্রসঙ্গে ‘ সােমপ্রকাশ ’ পত্রিকায় লেখা হয় — বাল্য বিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্যই বিধবা বিবাহের প্রয়াস নেওয়া হয় । অবশেষে সহবাস সম্মতি বিল পাস হলে মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম দশ থেকে বারাে হয় ।
অন্যান্য সামাজিক সংস্কার
বিদ্যাসাগর সে সময়কার সমাজের অন্যান্য বেশ কিছু সংস্কারকে দূর করতে চেয়েছিলেন । গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রথা , কুষ্ঠরােগী হত্যার নিয়ম , জাতিভেদ প্রথা , অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন । কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন । এই কুপ্রথাটির ইতিহাস পর্যালােচনা করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে শুধুমাত্র অর্থলােলুপতার জন্য এই প্রথা কতদূর হীন হতে পারে । কৌলীন্য প্রথার বলি হয়ে নারীরা সমাজে কতটা অসহায় হয়ে বেঁচে থাকে তা তিনি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে অনুভব করেন । তিনি হুগলী জেলার ১৩৩ জন ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্কের তালিকা তৈরি করে দেখান যে সমাজে কৌলীন্য প্রথার সুযােগ নিয়ে কুলীন ব্রাহ্মণেরা কীভাবে নারীদের সর্বনাশ করছে ।
বিদ্যাসাগরের সংস্কার কার্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে :
বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহের সমর্থনে আইন পাস করানাের জন্য সরকারের কাছে এক হাজার স্বাক্ষর সংবলিত এক আবেদন পত্র পাঠান , তখন তার প্রতিবাদ জানিয়ে রক্ষণশীল হিন্দু নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬ হাজার ৭৬৩ জন – এর স্বাক্ষর সংবলিত এক দরখাস্ত ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানাে হয়েছিল । যশােহরের হিন্দুধর্ম সংরক্ষণী সভা , কলকাতার ধর্মসভা এবং অধিকাংশ দেশীয় সংবাদপত্রে বিধবা বিবাহের বিরােধিতা করে লেখা প্রকাশিত হয় ।
বহু বিবাহের ক্ষেত্রে :
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বহুবিবাহ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের সমালােচনা করে লেখেন — আমাদের বিবেচনায় বহু বিবাহ নিবারণের জন্য আইনের প্রয়ােজন নাই ।
বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে :
বিদ্যাসাগর বাল্য বিবাহ প্রথা বন্ধের চেষ্টা করলে সে সময়কার বুদ্ধিজীবী ভূদেব মুখােপাধ্যায় এর বিরােধিতা করেছিলেন । সে সময়কার দৈনিক ‘ সমাচার চন্দ্রিকা’য় লেখা হয় — অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ না হলে স্বামী – স্ত্রীর মধ্যে সঠিক বােঝাপড়া ও সংমিশ্রণ গড়ে ওঠে না ।
মূল্যায়ন
সমাজ সংস্কারকরূপে বিদ্যাসাগর যে সমস্ত ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছিলেন তা নয় তবে , মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সমাজ সংস্কারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন । মহাদেব গােবিন্দ রাণাডে বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন , গবেষণা ও মৌলিকত্ব এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে তাঁর দেশের স্ত্রী জাতির বন্ধন মুক্তির কাজ করে বিদ্যাসাগর আগামী দিনের ভারতের ঘরে ঘরে আদর্শ ব্যক্তি ও মানব কল্যাণের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন । মাইকেল মধুসূদন দত্ত যথার্থই বলেছিলেন — “ বিদ্যাসাগরের ছিল প্রাচীন ভারতের ঋষিদের মতাে প্রতিভা ও বােধশক্তি , ইংরেজদের মতাে প্রবল উদ্যম এবং কর্মশক্তি ও বাঙালি মাতার মতাে কোমল হৃদয় ” ( Vidyasagar had the genius and wisdom of an ancient sage , the energy of an Englishman and the heart of a Bengalee mother ) ।