ইতিহাস

জাতিসংঘের ব্যর্থতার বা জাতিসংঘের পতনের কারণ

Contents

জাতিসংঘের ব্যর্থতার বা জাতিসংঘের পতনের কারণ

১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লিগ অব নেশন্স বা জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা বিশ্ব ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনা । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের করাল ছায়ায় বিশ্ববাসী যখন এক চিরস্থায়ী শান্তির জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল , ঠিক তখনই বৃহৎ শক্তিবর্গের উদ্যোগে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা বিশ্বরাজনীতিতে আশার আলাে জ্বালিয়েছিল । বিশ্বে শান্তি , শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা এবং যুদ্ধের আবহাওয়া সম্পূর্ণরূপে দূর করা — এই ছিল জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতিসংঘের কার্যকলাপ কিছুকালের মধ্যেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । জাতিসংঘ মাত্র কুড়ি বছর স্থায়ী হয়েছিল । জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণগুলি হল —

index 11
লিগ অব নেশন্স

মিত্রপক্ষের কর্তৃত্ব

জাতিসংঘ মূলত একটি ইউরােপীয় সংস্থারূপেই আত্মপ্রকাশ করেছিল । ইংল্যান্ড , ফ্রান্স সহ ইউরােপীয় দেশগুলিই অর্থাৎ মিত্রপক্ষীয় দেশগুলিই জাতিসংঘের কর্তৃত্ব করতে শুরু করায় এর ব্যর্থতা প্রথম থেকেই সুনিশ্চিত ছিল ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি

মার্কিন সেনেট অনুমােদন না করায় জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র যােগদান করেনি । আসলে ভার্সাই চুক্তি এই অনুমােদনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । বিশ্বের অন্যতম শিল্পসমৃদ্ধ ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান আমেরিকার অনুপস্থিতি জাতিসংঘের ভিত্তিকে দুর্বল দিয়েছিল ।

বৃহৎ শক্তিবর্গের অসমর্থন

রাশিয়া ও জার্মানিও প্রথমে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেনি । রাশিয়া লিগকে পুঁজিপতিদের এক সংস্থা হিসেবে গণ্য করে দূরে সরে ছিল । ফলে জাতিসংঘ প্রাথমিক সংগঠন পর্বেই বৃহৎ শক্তিবর্গের সমর্থন লাভ থেকে বঞ্চিত ছিল । এর ফলে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা জাতিসংঘের পক্ষে সম্ভব হয়নি ।

ভার্সাই চুক্তির ত্রুটি

ভার্সাই চুক্তির ( ১৯১৯ খ্রি. ) ত্রুটিপূর্ণ শর্তাবলির মধ্যেও জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ নিহিত ছিল । ওই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির ওপর যেসব অবমাননাকর শর্ত চাপানাে হয়েছিল , জাতিসংঘ ইচ্ছা করেই সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়ায় এর পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল ।

চোদ্দো দফা নীতির অপপ্রয়ােগ

জাতিসংঘের সনদে উদ্দেশ্য ও আদর্শ রচনার ক্ষেত্রে উইলসনের চোদ্দো দফা নীতির বিশেষ ভূমিকা ছিল । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই নীতির কোনাে বাস্তব প্রয়ােগ দেখা যায়নি ।

নিজস্ব সামরিক বাহিনীর অভাব

জাতিসংঘের সনদের নিয়ম অমান্যকারী দেশগুলির বিরুদ্ধে লিগ সরাসরি কোনাে ব্যবস্থা নিতে পারেনি । জাতিসংঘের নিজস্ব সামরিক বাহিনী ছিল না।

ইঙ্গ – ফ্রান্স স্বার্থ দ্বন্দ্ব

জাতিসংঘের অন্যতম দুই প্রধান সদস্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স প্রথম থেকেই নিজেদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ – সংক্রান্ত দ্বন্দ্ববিদ্বেষে লিপ্ত ছিল । ফলে তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য জাতিসংঘের বাঞ্ছিত নীতির প্রয়ােগ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হয় ।

নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা

১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে জেনেভায় অনুষ্ঠিত নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনের ব্যর্থতা জাতিসংঘের মৃত্যু – ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল । ওই সম্মেলনে জার্মানির চেয়ে ফ্রান্স অধিক সমরাস্ত্র সঞ্চয় করতে পারবে — এই নীতি গৃহীত হওয়ার আশঙ্কায় জার্মানি জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে ।

জাপানের আগ্রাসন রােধে ব্যর্থতা

জাপানের মারিয়া অধিকার এবং প্রাচ্য দেশীয় অংশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার জাতিসংঘ রােধ করতে পারেনি । এই জাপানই পরবর্তীকালে নিজের ইচ্ছামতাে লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করে ।

তােষণনীতি

ফ্রান্স ও ব্রিটেনের জার্মান তােষণ নীতি জাতিসংঘকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছিল । ফলে জাতিসংঘের পতন সুনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল । যার ফলে ইতালির আবিসিনিয়া অধিকারের প্রতিকার করতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয় ।

মন্তব্য

জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের স্বার্থসংঘাত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে জটিলতা বৃদ্ধি করে । পাশাপাশি জার্মানির উগ্র জাতীয়তাবাদী মনােভাবের প্রসার জাতিসংঘের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে । তাই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠাকালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— “ এটি লিগ অব নেশন্স হবে না , হবে লিগ অব রবারস ” জাতিসংঘের ব্যর্থতা একথাই প্রমাণ করেছিল যে , মানবসভ্যতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেলেও বিশ্বে শান্তিপ্রতিষ্ঠার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পােল্যান্ড আক্রমণ করলে জাতিসংঘের অবলুপ্তি ঘটে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!