ইতিহাস

ডিরোজিও ও নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন

Contents

ডিরোজিও ও নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন

ফরাসি বিপ্লবের মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং রুশাে , ভলতেয়ার , হিউম , লক , বেকন , টমপেইন , বেনথাম , রিড প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকের যুক্তিবাদী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এক যুব সম্প্রদায় হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিও – র নেতৃত্বে হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ ঘােষণা করেন , যা নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন নামে পরিচিত । ঐতিহাসিক তারাচাঁদের  মতে — “ রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে তাঁরা যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলেন তার ফলে চিন্তাজগতেও বিপ্লব ঘটেছিল । ”

untitled 57 18441 1
ডিরোজিও

নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের মতাদর্শ

দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুসমাজে ধর্মকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত কুসংস্কার প্রচলিত ছিল সেগুলির বিরুদ্ধে নব্যবঙ্গীয়রা সােচ্চার হয়েছিলেন । তাঁরা চেয়েছিলেন আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে সমস্ত ভণ্ডামি বা লােক দেখানাে নিয়মকানুন ছিল সেগুলির অবসান ঘটাতে । তাঁরা জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা , সতীদাহ প্রথাসহ বেশ কিছু কুপ্রথাকে সমুলে বিনাশ করার আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন । তাঁর ছাত্রদের প্রতি ডিরােজিওর শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল — “ স্বাধীন চিন্তার দ্বারা মত ও পথ স্থির করবে ; কোনাে প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুশীলন করবে না ; জীবনে ও মরণে একমাত্র সত্যকেই অবলম্বন করবে ; সৎ গুণ অনুশীলন করবে , আর যা কিছু অন্যায় ও অসৎ তা পরিহার করবে । ”

নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের গােষ্ঠীর সদস্যগণ

ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয় গােষ্ঠীর সদস্যগণ হলেন রামতনু লাহিড়ী , রসিককৃষ্ণ মল্লিক , কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় , রামগােপাল ঘােষ , দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায় , প্যারীচাঁদ মিত্র , লালবিহারী দে , মাধবচন্দ্র মল্লিক , তারাচাঁদ চক্রবর্তী , শিবচন্দ্র দেব , কিশােরী চাঁদ মিত্র , মাইকেল মধুসূদন দত্ত , রাধানাথ শিকদার , কাশীপ্রসাদ ঘােষ , মহেশচন্দ্র ঘােষ প্রমুখ । অধ্যাপক সুশােভন সরকারের  মতে — “ ডিরােজিয়ানরা তাঁদের শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি শেষ পর্যন্ত অনুগত ছিলেন এবং নিজেরা পারস্পরিক সহানুভূতি ও বন্ধুত্বের বাঁধনে আবদ্ধ ছিলেন ”।

নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কার্যাবলী

ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয়রা সে সময়কার সমাজের জাতিভেদ প্রথা , অস্পৃশ্যতা , সতীদাহ প্রথাসহ বিভিন্ন কুসংস্কার ও নানা আর্থসামাজিক কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেছিলেন । ডিরােজিয়ানরা হিন্দুসমাজের নিয়ন্ত্রক ব্রাহ্মণ পুরােহিতদের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ করে বলতেন — “ আমরা গরু খাই গাে । ” কালীঘাটের মা কালীকে সম্বােধন করতেন “ গুড মর্নিং ম্যাডাম ” বলে । ডিরােজিয়ানরা ফ্রান্সের ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কলকাতার টাউন হলে এক বিজয় উৎসব পালন করে ও ফরাসি বিপ্লবের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা মনুমেন্টে ( এখনকার শহিদ মিনার ) টাঙিয়ে দেয় ( ২৫ ডিসেম্বর ) । নব্যবঙ্গীয়রা সনাতন হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার তীব্র সমালােচনা করেন । রসিককৃষ্ণ মল্লিক  বলেন — ‘ আমি গঙ্গা নদীর পবিত্রতা বিশ্বাস করি না ’। আসলে নব্যবঙ্গীয়রা সমকালীন হিন্দু সমাজব্যবস্থা ও হিন্দুধর্মের গোঁড়ামিগুলিকে সহ্য করতে পারত না । ডিরােজিওর ছাত্র মাধবচন্দ্রের এক উক্তি থেকে এটি আরও স্পষ্টরূপে বােঝা যায় । মাধবচন্দ্র  বলেন — “ যদি আমরা আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে কোনাে কিছুকে ঘৃণা করে থাকি তবে তা হল হিন্দুত্ব । ”

অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন

ডিরােজিও তাঁর অনুগামীদের নিয়ে মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে গঠন করেন অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশন নামক এক বিতর্ক সভা ( ১৮২৮ খ্রি. ) । ডিরােজিও নিজে ছিলেন এর সভাপতি এবং ডিরােজিওর ছাত্র উমেশচন্দ্র বসু ছিলেন এর সম্পাদক । এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভারতের প্রথম ছাত্র সংগঠন । অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশনের বিভিন্ন অধিবেশনে সনাতন হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথা , অস্পৃশ্যতা , পৌত্তলিকতার ওপর আলােচনা ও বিতর্ক চলত । অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় লেখা হয় , “ অক্সফোর্ড , কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলি যে ভূমিকা পালন করে , হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশনও সেই ভূমিকা পালন করে । ”

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ

ডিরোজিওর অনুগামী ছাত্ররা ‘ পার্থেনন ’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ( ১৮৩০ খ্রি. ) । এই পত্রিকায় তাঁরা হিন্দুসমাজের বিভিন্ন কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশ করেন । হিন্দু কলেজের সহসভাপতি প্রাচ্যবাদী হােরেস হেম্যান উইলসন এই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের আগেই এটি বন্ধ করে দেন । কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ পার্সিকিউটেড ’ পত্রিকায় , মাধবচন্দ্র মল্লিক ‘ বেঙ্গল হরকরা ‘ পত্রিকায় হিন্দুসমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখেন । নব্যবঙ্গীয়দের প্রচেষ্টায় ‘ সােসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ ‘ নামক এক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ( ১৮৩৮ খ্রি. ) । ডিরােজিও নিজেও একই লক্ষ্য নিয়ে ‘ হেসপেরাস ’ , ‘ ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট ’ , ‘ ক্যালাইডােস্কোপ ‘ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন । ডিরােজিওর অনুগামীরা ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় ‘ জ্ঞানান্বেষণ ‘ ; ইংরেজি ভাষায় ‘ এনকুয়েরার ’ , ‘ বেঙ্গল স্পেকটেটর ’ , ‘ হিন্দু পাইওনিয়ার ’ নামক পত্রিকা প্রকাশ ও ‘ সাধারণ জ্ঞানােপার্জিকা সভা ’ ( ১৮৩৮ খ্রি. ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনের ধারা বজায় রাখেন । ডিরােজিও রচিত ফকির অব জাংঘিরা , টু ইন্ডিয়া মাই নেটিভ ল্যান্ড কবিতাগুলিতে তাঁর ভারতপ্রেমের পরিচয় মেলে ।

নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের অবসান

ডিরােজিওর মৃত্যুর পর থেকেই ক্রমশ নব্যবঙ্গ বা ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন উপযুক্ত নেতার অভাবে শ্লথ হয়ে পড়ে । ডিরােজিওর অনুগামীদের অনেকেই সমাজসংস্কারের পথ থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন এবং প্রাচীন হিন্দুত্ববাদী ধর্মের সঙ্গে নিজেদেরকে অঙ্গীভূত করে নেন ।

নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সমালোচনা

নব্যবঙ্গীয়রা বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচিত হয়েছেন ।

রক্ষণশীলদের প্রতিবাদ :

নব্যবঙ্গীয়রা অতি বাড়াবাড়ির জন্য জনসমর্থন বা গণসহযােগিতা পাননি । কেষ্টদাস পাল এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন — “ বড়াে বড়াে কথা বলা এবং বাস্তবে কিছুই না করা ছিল নব্যবঙ্গীয়দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । ” সেসময়কার ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিন , সংবাদ প্রভাকর , সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকাতেও নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিরােধিতা করে লেখা বের হয় । রক্ষণশীল শহুরে পরিবারগুলি কলকাতার হিন্দু কলেজে তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য ভরতি করাতে দ্বিধাবােধ করেন ।

আদর্শ চ্যুতি : 

নব্যবঙ্গীয়রা পরবর্তী সময় তাদের আদর্শ থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছিল , যার ফলে তাদের আন্দোলন সফলতা পায়নি । বিনয় ঘােষের  মতে — “ নব্যবঙ্গীয়রা সুবিন্যস্ত আদর্শের ভিত্তিতে কোনাে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি ” ।

দৃষ্টিভঙ্গির অভাব :

দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা নব্যবঙ্গীয়দের উদ্দেশ্যকে সফল হতে দেয়নি । সুমিত সরকারের  মতে — “ নব্যবঙ্গীয়রা পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের প্রভাবে অত্যাধুনিক বুর্জোয়া উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলেও ঔপনিবেশিক শাসনে যে তার রূপায়ণ সম্ভব নয় তা বুঝতে পারেননি ”।

গঠনমূলক কর্মসূচির অভাব :

গঠনমূলক কর্মসূচির অভাব নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনকে সফল হতে দেয়নি । এই আন্দোলন শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামীণ ভারতবাসীর সহযােগিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে । কেমব্রিজ ঐতিহাসিক ড. অনিল শীলের  মতে — “ তারা গজদন্ত মিনারে বসবাস করত ” ( They lived in ivory towers ) ।

উপসংহার

ডিরােজিওর নেতৃত্বে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা চলে না । নব্যবঙ্গীয়দের মধ্যে প্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পাশ্চাত্য আদর্শের সূর্যালােক প্রতিফলিত হয়েছিল । সাময়িক ভাবে হলেও নব্যবঙ্গীয়রা ভারতবর্ষের সমকালীন সমাজব্যবস্থা , ধর্মনীতি , শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আলােড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল । ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্রের মতে — “ নব্যবঙ্গীয়দের চিন্তাধারা আধুনিকতার নিরিখে রামমােহনের থেকেও প্রগতিশীল ছিল । ” সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়  তাঁর ‘ A Nation in Making ‘ গ্রন্থে লিখেছেন — “ এরাই বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক । এরাই আমাদের জাতির পিতা , এদের গুণাবলি আমাদের কাছে স্মরণীয় । ”

One thought on “ডিরোজিও ও নব্য বঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন

  • Mujahid Sk

    অনেক ধন্যবাদ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!