ইতিহাস

সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ

Contents

সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ

অর্থনৈতিক শােষণই হল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের প্রথম এবং প্রধান কথা । ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শােষণে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙে পড়ায় সমাজের সকল স্তরের মানুষ আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ স্বভাবতই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল । অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীর  মতে — সাধারণ ভারতবাসী জমি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার কারণে বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছিল ।

images 25
মহাবিদ্রোহ

সম্পদ লুণ্ঠন

১৭৫৭ খ্রি.  থেকে একশাে বছর ধরে ব্রিটিশ কর্তৃক বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লুণ্ঠন ভারতবর্ষকে অর্থনৈতিক দিক থেকে নিঃস্ব করে দেয় । পলাশির যুদ্ধের পর থেকে যে অর্থ নির্গমনের ক্ষীণধারা প্রবাহিত হতে শুরু হয়েছিল তা পরবর্তীকালে স্রোতস্বিনীতে রূপান্তরিত হয় ।

কুটিরশিল্প ধ্বংস

ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের স্বার্থে ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহের দেশে ও বিলাতি পণ্যের বাজারে পরিণত করা হয় । সুকৌশলে দেশীয় তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করা হয় । অষ্টাদশ শতক থেকে ভারতীয় বস্ত্রের রপ্তানি কমতে থাকে মূলত দুটি কারণে । প্রথমটি ছিল ইংল্যান্ডে ভারতীয় বস্ত্র রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা , দ্বিতীয়টি ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পজাত দ্রব্যের বিনা শুল্কে ভারতে আমদানি , এর সামগ্রিক প্রভাবরূপে ভারতীয় কুটিরশিল্প ধ্বংস হয় ।

কর্মহীনতা 

অগণিত তাঁতি ও কারিগর বৃত্তিচ্যুত হয়ে কর্মহীন শ্রমিকশ্রেণিতে রূপান্তরিত হয় । এ ছাড়াও দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হলে রাজপরিবারগুলির ওপর নির্ভরশীল অনুচর ও কর্মচারীরা কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে । কেবলমাত্র অযােধ্যাতেই অসংখ্য অসামরিক কর্মচারী ও প্রায় ২১ , ০০০ তালুকদারের আর্থিক সুযােগসুবিধা কেড়ে নেওয়া হয় । সেইসঙ্গে সেখানকার সেনাবাহিনীকেও ভেঙে দেওয়া হলে বহু সামরিক কর্মচারী ও অভিজাত পরিবারের জীবিকানির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায় । জন কে  লিখেছেন — বহু সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা রাত্রে ভিক্ষা করতেন ।

চাকরি সংরক্ষণ 

সরকারি ভাষারূপে ইংরেজির প্রবর্তনের ফলে সংস্কৃত , আরবি , ফারসি প্রভৃতি দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যে শিক্ষিত মানুষজন জীবিকা অর্জনের সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয় । সেইসঙ্গে কর্নওয়ালিশের সময় থেকে সরকারি উচ্চপদগুলি শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় শিক্ষিত ভারতীয়রাও ছিল ক্ষুদ্ধ ।

চড়া রাজস্ব

ব্রিটিশরা এদেশে নতুনভাবে যে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলন করে তাতে বহু জমিদার বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব দিতে না পারায় জমিদারি হারান । এসব জমিদারিগুলি দখল করে ব্রিটিশ – অনুগত মহাজনশ্রেণি , যারা নিষ্ঠুরভাবে হতদরিদ্র চাষিদের কাছ থেকে চড়া হারে রাজস্ব আদায় করে কৃষককুলের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তােলে । রাজস্ব মেটাতে গিয়ে কৃষকরা বাধ্য হয় মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে , যা কোনােদিনই তারা শােধ করতে পারত না ।

উপসংহার

লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে নিষ্কর জমি অনুসন্ধানের লক্ষ্যে বােম্বাইতে গঠিত ইনাম কমিশন ( ১৮৫২ – খ্রি . ) প্রায় ২০ হাজার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে । ব্রিটিশের নির্লজ্জ অর্থনৈতিক শােষণ গ্রামীণ ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামােকে পঙ্গু করে দেয় । ব্রিটিশ প্রশাসনের উচ্চ থেকে নিম্নপদ পর্যন্ত আর্থিক দুর্নীতিতে ভরে ওঠে । পি. জে. মার্শাল  তাঁর ‘ ইস্ট ইন্ডিয়া ফরচুন ’ গ্রন্থে লিখেছেন — পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই কোম্পানি পলকাটা হিরে ও হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর ধনসম্পদ এদেশ থেকে তাদের দেশে নিয়ে যায় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!