ইতিহাস

সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণ

Contents

সিপাহী বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণ 

পলাশির যুদ্ধের পর থেকে একশাে বছর ধরে কোম্পানির অপশাসনের ফলে জনসাধারণের মনে যে অসন্তোষ জমা হয়েছিল তার বিস্ফোরণ ঘটে এই মহাবিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে । বিভিন্ন দিক থেকে কোম্পানির শােষণ ও উৎপীড়ন যখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছােয় যে সামাজিকভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে , তখন বিদ্রোহের পরিস্থিতি তৈরি হয় ।

image 9691 1535552383 1
মহাবিদ্রোহ


সামাজিক বৈষম্য

শক , হন , পাঠান , মােগল প্রভৃতি বিদেশি জাতি ভারতবর্ষে এসে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজ – সংস্কৃতিতে লীন হয়ে যায় । কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ব্রিটিশ । সামাজিক বিচারে ইংরেজরা ছিল শাসক আর ভারতীয়রা ছিল শাসিত । এই বৈষম্য ভারতবাসীর চেতনাকে জাগিয়ে তােলে । এ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসু  বলেছেন , “ ভারত ব্রিটিশ আমলেই সর্বপ্রথম উপলদ্ধি করে যে সে বিজিত হয়েছে । ”

ভারতবাসীর প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞা

ভারতবাসী ব্রিটিশের চোখে ছিল ঘৃণার পাত্র । আগ্রায় এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট আইন জারি করে বলেছিলেন , কোনাে ইংরেজকে রাস্তায় দেখতে পেলেই তাকে ভারতবাসী সেলাম জানাতে বাধ্য থাকবে । বহু ইউরােপীয় ক্লাবের প্রবেশদ্বারে লেখা থাকত কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ । এ ছাড়াও বিটিশ রেস্তোরাঁ , পার্ক ও হােটেলসহ বিভিন্ন জায়গায় ভারতবাসীর প্রবেশের অনুমতি ছিল না । স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও ঘৃণার মনােভাব শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান তৈরি করে ।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বঞ্চনা 

১৮৩৩ – এর চার্টার আইনে জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি সরকারি উচ্চপদে যােগ্য ভারতীয়দের নিয়ােগের নীতি গৃহীত হলেও তা কখনােই বাস্তবায়িত হয়নি । কর্নওয়ালিশ ভারতীয়দের দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করায় তাদেরকে সরকারি উচ্চপদগুলি থেকে বঞ্চিত করে রাখেন । এই বঞ্চনা চলে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত । সেযুগে প্রশাসনিক বিভাগে ভারতীয়রা ডেপুটি কালেক্টর বিচারবিভাগের ক্ষেত্রে সদর আমিন পদ পর্যন্ত নিযুক্ত হতে পারতেন ।

মুসলমান ও হিন্দুদের রক্ষণশীলতা

ব্রিটিশের প্রতি ভারতবাসী কোনােদিনই আস্থা রাখতে পারেনি । মােগল শাসনের অবসানের পর ব্রিটিশ এদেশের শাসনভার গ্রহণ করায় মুসলমানরা কখনােই ব্রিটিশকে ভালাে চোখে দেখেনি । আবার সতীদাহ প্রথা রদ , শিশুহত্যা নিবারণ , গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন রদ , বিধবাবিবাহ প্রচলন ইত্যাদিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেওয়ায় রক্ষণশীল হিন্দুদের একাংশ ব্রিটিশের প্রতি ক্ষুদ্ধ ছিল । তা ছাড়া ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন , টেলিগ্রাফ স্থাপন , রেলপথের বিস্তার ইত্যাদি কার্যকলাপ হিন্দু – মুসলিম নির্বিশেষে উদারভাবে মেনে নিতে পারেনি ।

ইংরেজদের ব্যভিচার ও অত্যাচার

কোম্পানির শাসনকালে কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে যেভাবে আপামর ভারতবাসী অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয়েছে তার তুলনা মেলা ভার । কারণে – অকারণে কোল , ভিল , মুন্ডা , সাঁওতালসহ বিভিন্ন উপজাতিগােষ্ঠীর পরিবারকে ব্রিটিশ কর্মচারীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে , যা ভারতবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।

উপসংহার

সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ব্রিটিশবিরােধী মনােভাব নিয়ে এক তীব্র প্রতিবাদের তাগিদ অনুভব করেছিল । এই তাগিদ থেকেই সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা ঘটেছিল । ড . রমেশচন্দ্র মজুমদারের  মতে — বেশিরভাগ অঞ্চলগুলিতে সিপাহিদের অনুসরণ করে জনসাধারণ বিদ্রোহের প্রসার ঘটিয়েছিল (‘ In most of the localities the mutiny of the sepoys was followed by a widespread disturbance among the civil population ’) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!