তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ বলতে কি বুঝ
Contents
তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ বলতে কি বুঝ
সৈয়দ আহমেদ ভারতের ওয়াহাবি আন্দোলনকে প্রকৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন আর বাংলায় মীর নিশার আলি বা তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন তার পূর্ণ রূপ পায় । তিতুমীরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রাম বারাসাত বিদ্রোহ ( ১৮৩০ – ৩১ খ্রি. ) নামে পরিচিত । তিতুমীর কিন্তু ওয়াহাবি আদর্শ মেনে চলেননি । তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে বারাসত বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন । অধ্যাপক গৌতম ভদ্র বলেছেন , “ তিতুমীরের অনুগামীরা নিজেদের হেদায়তী ( সঠিক পথে পরিচালিত বা নির্দেশিত হওয়া ) বলত এবং তাঁর আন্দোলনকে বলা হত তরিকা-ই-মুহম্মদিয়া বা মহম্মদের পথ । ”

তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের আদর্শ
তিতুমীরের নেতৃত্বে বারাসাত বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করা । এ ছাড়াও , তিতুমীর তাঁর অনুগামীদের যে সকল আদর্শ মেনে চলার কথা বলেন , সেগুলি হল —
- পির – পয়গম্বরকে মানার প্রয়ােজন নেই ।
- মন্দির , মসজিদ তৈরির প্রয়ােজন নেই ।
- ফয়েতা ( শ্রাদ্ধশান্তি ) অনুষ্ঠান করার প্রয়ােজন নেই ।
- অনুগামীদের দাড়ি রাখতে হবে ।
- সুদে টাকা খাটানাে নিষিদ্ধ কাজ ।
জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
তিতুমীরের মূল সংগ্রাম ছিল পিরবাদ ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে । ২৪ পরগনা জেলার পুঁড়া গ্রামের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরের অনুগামীদের দাড়ির ওপর বার্ষিক আড়াই টাকা কর ধার্য করেন , ওয়াহাবিদের আরবি নাম গ্রহণের ওপর পঞ্চাশ টাকা কর চাপান এবং বলেন তাঁর জমিদারি এলাকার মধ্যে ওয়াহাবি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলে পাকা ( ইটের তৈরি ) বাড়ির ক্ষেত্রে এক হাজার ও কাঁচা ( মাটির তৈরি ) বাড়ির ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা কর আদায় করা হবে । এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিতুমীর তাঁর ৩০০ জন অনুগামী নিয়ে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের বাড়ি আক্রমণ করেন এবং একটি গাে – হত্যা করে তার রক্ত মন্দিরে ছড়িয়ে দেন । তিনি টাকি ও গােবরডাঙার জমিদারদের কাছ থেকে খাজনা দাবি করেন ।
বাঁশের কেল্লা
তিতুমীর নিজেকে বাদশাহ হিসেবে ঘােষণা করেন এবং ২৪ পরগনা জেলার বাদুরিয়া থানার ১০ কিমি দূরে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে সমান্তরাল প্রশাসন চালাতে থাকেন । এই প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী হন মৈনুদ্দিন ( মতভেদে মুইজউদ্দিন বিশ্বাস ) , সেনাপতি হন তিতুমীরের ভাগ্নে গােলাম মাসুম এবং গােয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় মিস্কিন শাহকে । তিনি এখান থেকে জমিদার , নীলকর এমনকি বারাসত থেকে বসিরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চলা কোম্পানির অপশাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন । তিতুমীরের নির্দেশে প্রজারা জমিদারদের খাজনা বয়কট করে ।
তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের অবসান
প্রথম দিকে তিতুমীরের এই ঔদ্ধত্য কোম্পানি বিশ্বাস করতে না চাইলেও বারাসত ও নদিয়া জেলার মাজিস্ট্রেটের রিপাের্ট পেয়ে কোম্পানি তিতুমীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় । প্রথমে নদিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট এডওয়ার্থ স্মিথ তিতুমীরকে দমন করতে ব্যর্থ হন । তিতুমীরের নেতৃত্বে বারাসত বিদ্রোহ চরমে পৌছলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমীরকে দমনের জন্য কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দশম পদাতিক বাহিনী পাঠান । ইংরেজ সেনাবাহিনীর কামানের গােলার আঘাতে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে যায় । সংঘর্ষে তিতুমীর প্রাণ হারালে ( ১৮৩১ খ্রি , ১৯ নভেম্বর ) বারাসত বিদ্রোহের অবসান ঘটে ।
তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের প্রকৃতি
সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকায় তিতুমীরের বিদ্রোহকে হিন্দু বিরােধী মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে উল্লেখ করা হয়েছে । ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে , এই বিদ্রোহ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মুসলিম সম্প্রদায়ের আক্রমণ । আবার বিহারীলাল সরকার , কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ এই বিদ্রোহকে ‘ ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড ‘ বলে অভিহিত করেছেন ।
তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহের গুরুত্ব
তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল প্রয়ােজনীয় শক্তি , অর্থের অভাবে । তবে যেভাবে এই বিদ্রোহের মাধ্যমে জমিদারশ্রেণির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষ বিষােদগার করেছিল তাতে ভবিষ্যতে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্যে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত হয়েছিল বলা চলে ।