সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ/চরিত্র বা প্রকৃতি ও গুরুত্ব বা ফলাফল

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ/চরিত্র বা প্রকৃতি ও গুরুত্ব বা ফলাফল

কোম্পানি শাসনকালে ভারতে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ ঘটেছিল , সেগুলির মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ ও জঙ্গি বিদ্রোহ ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ । ‘ দামিন – ই – কোহ ’ ( পাহাড়ের প্রান্তদেশ ) – র বাসিন্দা , শান্তিপ্রিয় অরণ্যচারী উপজাতি সাঁওতালরা বেশ কয়েকটি কারণে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল । পি. সি. জোশি  তাঁর ‘ Santal Rebellion ‘ নামক গ্রন্থে লিখেছেন — সাঁওতাল বিদ্রোহের বিশেষ দিক ছিল স্বাধীনতার কামনা , সাঁওতাল অঞ্চল ও সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা ।

santhal rebelion1
The Santhal Rebellion

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ

সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম কয়েকটি কারণ ছিল —

খাজনা ও উপশুল্ক আরোপ : 

আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত সাঁওতালদের আদি বসবাসস্থানে কোম্পানি নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটালে সাঁওতালদের আবাদি জমিগুলি ধীরে ধীরে জমিদারদের হাতে চলে যায় । ফলে সাঁওতালরা বাধ্য হয়ে এসব অঞ্চল ছেড়ে ব্রিটিশের খাস এলাকা রাজমহলের পার্বত্য সমতলভূমিতে ( ভাগলপুর অঞ্চল ) এসে বসবাস শুরু করে । এখানকার বনাঞ্চল পরিষ্কার করে ও পাথুরে জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করে তারা অঞ্চলটির নাম দেয় ‘দামিন – ই – কোহ’। কিন্তু এখানেও কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে সুপারিনটেনডেন্ট পন্টেট – এর মাধ্যমে বিভিন্ন খাজনা ও উপশুল্ক আদায় শুরু করলে সাঁওতালরা হুল বা বিদ্রোহ ঘােষণা করে ।

বন্ড প্রথা : 

পাকুর ও মহেশপুরের রাজারা বহিরাগত জমিদার ও সুদখাের মহাজনদের হাতে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে লিজ দেয় । অভাবের তাড়নায় এইসব মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ ( খাদ্যশস্য বা অর্থ ) নিলে সাঁওতালদের কামিয়াতি হারওয়াহি নামক দু – ধরনের বন্ডে সই করতে হত । কামিয়াতি ব্যবস্থায় যতদিন না ঋণ নেওয়া সাঁওতাল দাদন শােধ দিতে পারত ততদিন তাদেরকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হত । আর হারওয়াহি ব্যবস্থার দাদন শােধ করতে ব্যর্থ সাঁওতালদের মহাজনদের জমিতে শ্রমদানের পাশাপাশি অন্যান্য কাজকর্মও করতে হত । এ প্রসঙ্গে সিধু বলেছেন — মহাজনরা আমাদের ওপর অত্যাচার করে এবং ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ সুদ আদায় করে ।

ব্যবসায়ীদের কারচুপি : 

সাঁওতাল পরগনাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরলতা ও অশিক্ষার সুযােগ নিয়ে সাঁওতালদের ঠকাত । তারা বেচারাম বা ছােটো বাউ নামক বাটখারার দ্বারা হিসাবের কম ওজনের দ্রব্য বিক্রি করে সাঁওতালদের ঠকাত । আবার সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনাে শস্য কেনার সময় হিসাবের থেকেও ভারী ওজনের কেনারাম বা বরা বাউ বাটখারা ব্যবহার করে বেশি পরিমাণ দ্রব্য ক্রয় করত । একসময় এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারচুপি জানতে পেরে সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ।

রেলকর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার : 

লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে রাজমহল , রামপুরহাট , ভাগলপুর , সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয় । রেলকর্মচারী ও ঠিকাদারেরা ওইসময় ওইসব অঞ্চলের সাঁওতালদের কাজে লাগায় । পরিশ্রম অনুযায়ী সাঁওতালদের মজুরি না দিয়ে তাদের কাছ থেকে জোর করে হাঁস , মুরগি , পাঁঠা কেড়ে নিতে শুরু করে । এতে সাঁওতালরা আর চুপ করে থাকতে না পেরে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে ।

সাঁওতালি নিয়মনীতির উচ্ছেদ : 

বাংলার ছােটোলাট ফ্রেডারিক হ‍্যালিডে সাঁওতাল অঞলে সাঁওতালি নিয়মনীতির উচ্ছেদ ঘটিয়ে কোম্পানির নিয়মকানুন প্রচলন করলে সাঁওতালরা বিচলিত হয়ে ওঠে এবং কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ( ১৮৫৫ খ্রি ) । সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু কানু ঘােষণা করেন — ঈশ্বরের নির্দেশ তাঁরা পেয়েছেন । শত্রু ধ্বংসের জন্য সাঁওতালদের তাই বিদ্রোহ করা প্রয়ােজন ।

অরণ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ : 

অরণ্যের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপও এই বিদ্রোহের এক প্রধান কারণ । ‘ Freedom Struggle ’ গ্রন্থে বিপান চন্দ্র , বরুণ দে  ও অমলেশ ত্রিপাঠী  বলেছেন যে , অরণ্যে সাঁওতালদের অধিকারকে কেন্দ্র করেই সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ।

সাঁওতাল বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি

চরিত্র বা প্রকৃতিগত বিচারে সাঁওতাল বিদ্রোহ একটি উপজাতি বিদ্রোহ হলেও এই বিদ্রোহ একটি কৃষক অভ্যুত্থানও বটে । এই বিদ্রোহ সাঁওতালদের কাছে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ হলেও তাতে ব্রিটিশ সমর্থনপুষ্ট জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় । সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণে ডব্লিউ  ডব্লিউ হান্টার  লিখেছেন — সাঁওতাল ও বর্ণহিন্দুদের মধ্যবর্তী অর্ধ – আদিবাসী সম্প্রদায় এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুরাও সাঁওতাল বিদ্রোহে যােগ দিয়েছিল । সাঁওতাল বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় ।

গণমুখী বিদ্রোহ : 

সাঁওতাল বিদ্রোহ শেষের দিকে গণমুখী চরিত্র লাভ করেছিল । কুমাের , কামার , গােয়ালা , চামার , তেলি , ডােমসহ বহু নিম্নশ্রেণির হিন্দু এই বিদ্রোহে যােগ দিয়ে এই বিদ্রোহকে গণমুখী করে তুলেছিল । অধ্যাপক কালীকিঙ্কর দত্ত  এ প্রসঙ্গে লিখেছেন — সাঁওতাল বিদ্রোহ ক্রমশ নিম্নশ্রেণির গণবিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল ।

শােষিতদের বিদ্রোহ : 

মহাজন , জমিদার , ঠিকাদার , নীলকর সাহেবদের শােষণের বিরুদ্ধে , সর্বোপরি ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় জুলুম ও নির্মম পীড়নের বিরুদ্ধে এক তীব্র জেহাদ ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ । তাই এই বিদ্রোহে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শােষিত মানুষও যােগ দিয়েছিল ।

দরিদ্রদের মুক্তি যুদ্ধ : 

সাঁওতাল বিদ্রোহ কেবল একটি উপজাতি বিদ্রোহই ছিল না , এটি ছিল সব সম্প্রদায়ের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের একটি বিদ্রোহ । নিম্নবর্গের সমাজের প্রায় সকল শ্রেণির ও পেশার দরিদ্র মানুষও এই বিদ্রোহে সাঁওতালদের পক্ষে যােগ দিয়েছিল । অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ  তাই এই বিদ্রোহকে নানা সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষের মুক্তিযুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন ।

আবাল বৃদ্ধ বনিতার বিদ্রোহ : 

কিশােরকিশােরী , যুবক যুবতী , বৃদ্ধ বৃদ্ধা — সব বয়সের সাঁওতাল নরনারী এই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল । সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ভাগনাডিহির মাঠে দশ হাজার সাঁওতালের ( কিশাের , মহিলা ও বৃদ্ধসহ ) মিলিত সমাবেশেই স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষিত হয় ( ১৮৫৫ খ্রি. ৩০ জুন ) ।

ব্রিটিশবিরােধিতা : 

কেবল জমিদার ও মহাজনবিরােধীই নয় , এটি ছিল স্পষ্টতই ব্রিটিশবিরােধী একটি আপসহীন সশস্ত্র গণসংগ্রাম । বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে তাই বলেছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশের শাসনের অবসান ঘটানাে ।

গুরুত্ব : 

সাঁওতাল বিদ্রোহে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত আধা – আদিবাসীশ্রেণি এবং নিম্নবর্ণের গরিব হিন্দুরাও যােগ দিয়েছিল । প্রথমদিকে কৃষিজমি রক্ষা ও বসত জমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আন্দোলন শুরু হলেও পরে এই আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীনতাকামী মনােভাব প্রকাশ পায় । ডব্লিউ. জি. আর্চারের  মতে , সাঁওতাল বিদ্রোহের একটা গভীরতর কারণ হচ্ছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব বা ফলাফল

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর সুদূরপ্রসারী পরােক্ষ ফলের জন্য বিদ্রোহটি ছিল বিশেষ  গুরুত্বপূর্ণ । এ প্রসঙ্গে ড. কালীকিঙ্কর দত্ত  তাঁর ‘ The Santal Insurrection of 1855 – 57 ‘ গ্রন্থে লেখেন বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ নবযুগের সূচনা করে ( ‘ This episode opened a new chapter in the history of Bengal and Bihar ‘ ) ।

সাঁওতাল পরগনা গঠন : 

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলেই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ উত্তরে গঙ্গার কাছাকাছি তেলিয়া গড়াই পরগনার সঙ্গে বীরভূম ও ভাগলপুর থেকে ৯০০০ বর্গকিলােমিটার এলাকা জুড়ে একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগনা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে । বলা হয় সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোনাে আইনবিধি কার্যকর করা হবে না ।

বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি : 

সমগ্র সাঁওতাল পরগনায় পুলিশ বাহিনীর বদলে মাঝি-পরগনাইত প্রভৃতি সাঁওতাল গোষ্ঠীপতিদের বিশেষ অধিকার স্বীকার করে নিয়ে তাদের ওপরই শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় । বাজেয়াপ্ত গবাদিপশু সাঁওতালদের পুনরায় ফিরিয়ে দেওয়া হয় । সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।

ইংরেজদের প্রবেশাধিকার : 

তিন বছরের জন্য ওই পরগনায় মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় । কিন্তু সেখানে ইউরােপীয় মিশনারিদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা করে সাঁওতালদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নীতি গৃহীত হয় । সাঁওতালদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হয় ।

ভূমি ব্যবস্থা : 

সরকার সাঁওতাল – অধ্যুষিত অঞ্চলের ভূমিব্যবস্থার যাবতীয় সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয় । তবে সেখানে ভূমিরাজস্ব আদৌ কমানাে হয়নি ।

খেরওয়ার আন্দোলনের সূচনা : 

পুরাতন রীতিনীতি , আচার ব্যবহার ছেড়ে হিন্দুদের অনুকরণে নিজস্ব মূল্যবােধ তৈরি ও শুদ্ধ জীবনচর্চা গড়ে তােলার লক্ষ্যে খেরওয়া ( সাঁওতাল ) – রা ভগীরথ মাঝির নেতৃত্বে এবার খেরওয়ার আন্দোলনের সূচনা ঘটায় । স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ ছিল এই খেরওয়ার আন্দোলন ( ১৮৭০ – ১৮৮২ খ্রি . ) ।

উপসংহার

আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য টাঙ্গি ও তিরধনুক নিয়ে সাঁওতালরা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে গুজরাতের নইকদা আন্দোলন (১৮৬৮ খ্রি.) । সুপ্রকাশ রায়ের  মতে , “ এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিয়াছিল এবং ইহা ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ । “

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!