ওয়াহাবি আন্দোলন কি আলোচনা কর

ওয়াহাবি আন্দোলন কি আলোচনা কর

উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত অন্যতম ইসলামিক আন্দোলন ছিল ওয়াহাবি আন্দোলন । সংখ্যালঘু মুসলিমদের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন পরিচালিত হলেও সমাজের নিম্নবর্গের হিন্দুরাও এই বিদ্রোহে যােগ দিয়ে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল ।অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরীর  মতে — ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক আন্দোলন ।

wahabi movement 1
Wahhabi Movement

ওয়াহাবি আন্দোলনের উৎস 

ওয়াহাবি‘ শব্দটি আরবীয় সংস্কারক মহম্মদ – বিন – আবদুল ওয়াহাবের নাম থেকে এসেছে । ওয়াহাবি এই শব্দটির অর্থ হল নবজাগরণ ( re-generation ) । ওয়াহাবি আন্দোলনের আসল নাম হল তারিখ – ই – মহম্মদিয়া  ( মহম্মদ নির্দেশিত পথ ) । অষ্টাদশ শতকে মহম্মদ – বিন – আবদুল ওয়াহাব নামক এক ব্যক্তি আরবে ইসলাম ধর্মের কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে প্রথম এক আন্দোলন গড়ে তােলেন । তাকে অনুসরণ করে ভারতের ওয়াহাবি সম্প্রদায় । উনিশ শতকের সূচনালগ্নে দিল্লির মুসলিম সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভারতে এই আন্দোলনের সূচনা ঘটান ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের লক্ষ্য

সূচনা পর্বে ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ । কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনের লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় । আন্দোলন সামন্ততন্ত্র ও ব্রিটিশবিরােধী হয়ে ওঠে । উত্তরপ্রদেশে রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভি ছিলেন ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা । তিনি ওয়ালিউল্লাহের পুত্র আজিজের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের কথা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে শুরু করেন । তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত করা এবং ব্রিটিশ অপশাসনের উচ্ছেদ ঘটানাে ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ

  • সৈয়দ আহমেদ তার দুই অনুচর বিলায়েত আলি ও এনায়েত আলিকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ওয়াহাবি কেন্দ্র স্থাপন করেন । তাঁরা পাটনায় ওয়াহাবি কেন্দ্রের খলিফা নিযুক্ত হন । সৈয়দ আহমেদ কলকাতায় ওয়াহাবি আদর্শ প্রচার করেন । এই আন্দোলন মূলত ইংরেজ বিরােধী হলেও পাঞ্জাবের শিখদের সঙ্গে ওয়াহাবিরা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন । শিখদের বিরুদ্ধে ‘ বালাকোটের যুদ্ধে ‘ সৈয়দ আহমেদ নিহত হন ( ১৮৩১ খ্রি . ) ।
  • ওয়াহাবি আন্দোলনের সংগঠনকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে সৈয়দ আহমেদ চারজনকে খলিফা বা ধর্মগুরুর পদে নিয়ােগ করেন । এরা হলেন এনায়েত আলি , বিলায়েত আলি , ফারহাৎ হােসেনমহম্মদ হােসেন । তারপর ইয়া-হিয়া আলির উদ্যোগে গঠিত হয় এক কেন্দ্রীয় কমিটি , যার অন্যতম কয়েকজন সদস্য ছিলেন । আবদুল রহিম , আবদুল গফফর , ইলাহি বক্স । আমানুল্লা ছিলেন এই কমিটির সভাপতি । 

ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রসার

সৈয়দ আহমেদের মৃত্যর পর এই আন্দোলন উত্তর – পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ , পাঞ্জাব , বাংলা , বিহার , মিরাট , হায়দ্রাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করে ।

তিতুমীরের বারাসত বিদ্রোহ

বাংলাতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রসারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা নেন তিতুমীর আসল নাম মীর নিশার আলি । সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতিনিধিরূপে তিনি একক প্রচেষ্টায় ওয়াহাবি আন্দোলনকে খুলনা , যশােহর , ঢাকা , রাজশাহি , মালদা , ২৪ পরগনা , নদিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তৃত করেন । বাদুরিয়া থানার ১০ কিমি দূরে নারকেলবেড়িয়া নামক গ্রামে তিনি একটি বাঁশের কেল্লা তৈরি করে নিজস্ব প্রশাসন গড়ে তােলেন । লর্ড বেন্টিকের নির্দেশে কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে দশম ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনীর আক্রমণে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় ও তিতুমীর নিহত হন ( ১৮৩১ খ্রি , ১৯ নভেম্বর ) ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

ওয়াহাবি আন্দোলন শেষপর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় 一

কর্মসূচি ও মানসিকতার অভাব : 

সঠিক রাজনৈতিক কর্মসূচি , অস্ত্রশস্ত্র এবং সশস্ত্র আন্দোলনের মানসিকতর অভাব এই বিদ্রোহকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করেছিল ।

পরিচালন ব্যর্থতা : 

সুপরিকল্পিত রণনীতির দ্বারা নিম্নবর্গের মানুষ আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেনি , ফলে আন্দোলন ব্যর্থ হয় ।

হিন্দু – বিমুখতা : 

আন্দোলনের নেতৃবর্গ ভারতের গরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়কে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার কোনাে উদ্যোগ নেয়নি । এমনকি তিতুমীরসহ বেশ কিছু নেতা হিন্দু জমিদারসহ অভিজাতদের আক্রমণ করায় হিন্দু সম্প্রদায় এই বিদ্রোহ থেকে দূরে থাকে ।

দমন নীতি : 

ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি আন্দোলনকে ব্যর্থ করে ।

ওয়াহাবি আন্দোলনের গুরুত্ব

ওয়াহাবি আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না । কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে এই আন্দোলন যে লড়াইয়ের নিদর্শন রেখেছিল তা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে কৃষকসমাজকে উৎসাহী করে তােলে । জাতীয় আন্দোলনে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাব প্রসঙ্গে চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল  লিখেছেন — ওয়াহাবিদের আত্মত্যাগ প্রথম পর্বের জাতীয় আন্দোলনের কর্মীদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!