ইতিহাস

ফরাজি আন্দোলন আলোচনা কর

Contents

ফরাজি আন্দোলন আলোচনা কর

উনিশ শতকে ভারতে মুসলিম সমাজের পুনরুজ্জীবন ( অর্থাৎ আর্থসামাজিক উন্নয়ন , রাজনৈতিক অধিকার অর্জন ) এবং ইসলামের সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা ফরাজি আন্দোলন নামে পরিচিত । অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ  তাঁর ‘ ওয়াহাবি অ্যান্ড ফরাজি রেবেলস্ অব বেঙ্গল ‘ – গ্রন্থে লিখেছেন , এই আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে একটি কৃষক আন্দোলন , যেখানে সাম্প্রদায়িকতার কোনাে গন্ধই ছিল না ।

haji shariatullah 1
Haji Shariatullah

ফরাজি আন্দোলনের উৎপত্তি

ফরাজি’ শব্দটি আরবি শব্দ ফরাজ থেকে এসেছে । ফরাজি শব্দের অর্থ হল ‘ ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য ’ বা ইসলাম ধর্মের আদর্শে বিশ্বাস । ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরিয়ৎ উল্লাহ ফরাজি নামক এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন । ফরাজি সম্প্রদায়টি নীলকর সাহেব ও হিন্দু – মুসলিম জমিদারদের বিরুদ্ধে এক সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তােলার প্রস্তুতি শুরু করে ।

ফরাজি আন্দোলনের আদর্শ

হাজি শরিয়ৎউল্লাহ ছিলেন ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক । তিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষকে দার – উল – হারব ( শত্রুর দেশ ) রূপে চিহ্নিত করে বলেন , ব্রিটিশ – শাসিত ভারত ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বসবাসের যােগ্য নয় । সব মুসলমানকে তিনি ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শের প্রতি পুনরুত্থান ঘটানাের জন্য আবেদন জানান । তিনি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের রুখে দাঁড়ানাের আবেদন জানান এবং কোরানের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হয়ে কলমা , নামাজ , রােজা , জাকাৎ , হজ ইত্যাদি ধর্মাচরণের নির্দেশ দেন । এর পাশাপাশি তিনি মুসলিম সমাজে যে সকল হিন্দু রীতিগুলির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল সেগুলি বর্জনের কথা বলেন ।

ফরাজি আন্দোলনের নেতৃবর্গ

শরিয়ৎউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদুমিঞা ( আসল নাম মহম্মদ মহসিন আলাউদ্দিন আহম্মদ ) আন্দোলন পরিচালনা করেন । দুদুমিঞা ঘােষণা করেন — জমির মালিক হলেন ঈশ্বর , যারা জমি চাষ করছে জমি তাদেরই । দুদুমিঞা বাহাদুরপুর গ্রামে মারা গেলে তার দ্বিতীয় পুত্র নােয়ামিঞা ( আসল নাম আবদুল গফুর ) আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন । ফরাজি নেতৃবর্গ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাদের আদর্শ প্রচারের জন্য ফারসি , আরবি অথবা উর্দুর পরিবর্তে বাংলা ভাষায় প্রচার চালান । নােয়ামিঞা ব্রিটিশ ও জমিদার বিরােধিতার পরিবর্তে ধর্মীয় আন্দোলনরূপে ফরাজি আন্দোলনকে পরিচালিত করেন । নােয়ামিঞার মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা সৈয়দ আল – দিন – আহ‌্মদ ফরাজি আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিলেও এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় । ড . শশীভূষণ চৌধুরী  বলেন — দুদুমিঞা তাঁর অনুগামীদের কাছে ছিলেন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জ্বলন্ত প্রতীক ।

ফরাজি আন্দোলনের প্রসার

ক্রমশ ফরিদপুর ও ঢাকা থেকে ফরাজি আন্দোলন খুলনা , ময়মনসিংহ , কুমিল্লা , যশােহরসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে । ১৮৩৯ – ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে । ফরাজিরা ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত পাঁচচরে অবস্থিত ইংরেজ নীলকর ডানলপের কুঠি আগুনে পুড়িয়ে দেয় ও গােমস্তা কালিপ্রসাদকে খুন করে ।

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি

ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে মতভেদ আছে —

  • প্রথমদিকে ফরাজি আন্দোলন ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ধর্মীয় সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও অবশেষে তা জমিদার ও নীলকর বিরােধী কৃষক আন্দোলনে পর্যবসিত হয় ।
  • ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হলেও ফরাজি আন্দোলন অবশেষে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি । মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারাই এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল । পাকিস্তানি ইতিহাসবিদ মুইনউদ্দিন আহমেদ খান  বলেছেন — ফরাজি আন্দোলন ছিল অমুসলমান ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষকদের ধর্মীয় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ।
  • ফরাজি আন্দোলনে দরিদ্র মুসলিম কৃষকশ্রেণি যােগ দিলেও তা শেষ পর্যন্ত শ্রেণিসংঘর্ষে রূপান্তরিত হয় । এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম হান্টার  বলেছেন — ফরাজি আন্দোলন ছিল একটি শ্রেণিসংঘর্ষ ।

ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

শেষপর্যন্ত ফরাজি আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল বেশ কয়েকটি কারণে 一

সংহতির অভাব : 

সংকীর্ণ ধর্মবােধ দ্বারা এই আন্দোলন পরিচালিত হওয়ায় উদারপন্থী মুসলমান সমাজ এই  আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকে । ফলে সংহতির অভাবে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয় ।

লক্ষ্যহীনতা : 

কোনাে সুস্পষ্ট লক্ষ্য না থাকায় এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল । প্রথমদিকে মুসলিমদের উন্নয়ন , পরবর্তী সময়ে নীলচাষ ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের লক্ষ্য নিয়ে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল ।

সীমাবদ্ধতা : 

এই আন্দোলন একটি অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । এ ছাড়াও ইংরেজ , নীলকর , জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে অর্থ , লােকবল , সমর উপকরণ ও মানসিকতার প্রয়ােজন ছিল তা বিদ্রোহীদের ছিল না ।

জনসমর্থনের অভাব : 

গণসমর্থনের অভাব ছিল এই আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম একটি কারণ । মুসলমান অভিজাত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই এই আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি ।

ফরাজি আন্দোলনের গুরুত্ব 

ফরাজিদের প্রচেষ্টা পরবর্তী প্রজন্মকে বিদ্রোহের প্রেরণা জুগিয়েছিল । কেবল মুসলিমরাই নয় , হিন্দু কৃষকরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল । তাই ড . অভিজিৎ দত্ত  বলেছেন , ফরাজিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ করতে না পারলেও বাংলা থেকে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদ কামনা করেছিল ( ‘…desired the summary onstar at the English from Bengal ‘ ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!