চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি আলোচনা কর
Contents
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি আলোচনা কর
চিরস্থায়ী ব্যবস্থার প্রথম প্রস্তাবক ছিলেন স্কটিশ চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাফ । লর্ড কর্নওয়ালিশ সর্বপ্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন ( ১৭৯৩ খ্রি . ২২ মার্চ ) । জে. সি. মার্শম্যানের মতে , এটা ( চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ) ছিল একটি দৃঢ় , সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ (‘ It was a bold , brave and wise measure ’) ।

রাজস্ব আদায়ে পরীক্ষানিরীক্ষা
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর থেকেই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে । খুব সহজভাবে অথচ বেশি পরিমাণে কীভাবে রাজস্ব আদায় করা যায় এ নিয়ে কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ভূমি ব্যবস্থার উদ্ভাবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষারই ফলশ্রুতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ।
সমকালীন অর্থনীতিবিদদের প্রভাব
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম প্রবক্তা আলেকজান্ডার ডাফ বাণিজোর উন্নতির লক্ষ্যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন । তিনি বলেন , রাজস্বে স্থায়ী বন্দোবস্ত করা গেলে কৃষি ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে , আর কৃষির উন্নতি ঘটলে বাণিজ্যও সমৃদ্ধ হবে । স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কৃষিকলাবিদ হেনরি পাত্তুলো প্রাকৃতিক সম্পদকেই আয়ের মূল উৎস বলে উল্লেখ করে জমিতে চিরস্থায়ী ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করেন ।
কোম্পানির গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের গরিষ্ঠ অংশ দীর্ঘদিন ধরে জমিদারদের জমা ( নির্ধারিত রাজস্ব ) চিরতরে নির্দিষ্ট করার পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছিলেন । ওয়ারেন হেস্টিংস যখন পাঁচশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন তখনই ফিলিপ ফ্রান্সিস , ডেকারেজ , মিডলটন প্রমুখ কর্মচারীবৃন্দ ভূমিরাজস্বের হার স্থায়ী করার দাবি তােলেন । তাদের এই দাবিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ও কোম্পানির বাের্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি জান্ত্রাস প্রভাবিত হন ।
পিটের আইন ও পরিচালক সভার প্রভাব
পিটের ভারতশাসন আইনে ( ১৭৮৪ খ্রি . ) বারবার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার পরীক্ষানিরীক্ষার ক্ষতিকর প্রভাবকে লক্ষ্য রেখে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুপারিশ করা হয় । এর দুবছর পরে কোম্পানির পরিচালক সভা ঘনঘন রাজস্ব ব্যবস্থা পরিবর্তনের তীব্র সমালােচনা করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশকে বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ভারতে পাঠায় ।
কর্নওয়ালিশের প্রচেষ্টা
গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসে লর্ড কর্নওয়ালিশ রাজস্ব হার , জমার পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালান । অবশেষে তিনি বাংলা , বিহার ( ১৭৮৯ খ্রি . , ১০ ফেব্রুয়ারি ) এবং ওড়িশা ( ১৭৯০ খ্রি . )- র জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের কথা ঘােষণা করেন , যা দশশালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত হয় । পরিচালক সভার অনুমােদন পেয়ে দশশালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রুপান্তরিত করা হয় ( ১৭৯৩ খ্রি . , ২২ মার্চ )।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্ত সমূহ
দেওয়ানি লাভের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ দিতে চাইলে ইংল্যান্ডের বাের্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি জান্ট্রাস ও প্রধানমন্ত্রী উইলিয়ম পিট তা অনুমােদন করেন ।
এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি ছিল —
- বংশপরম্পরায় জমি ভােগদখল করে আসছেন এরূপ জমিদাররা বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে খাজনা দিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে জমির স্বত্ব ভােগ করতে পারবে ।
- জমিদার বা ইজারাদাররা আদায় করা রাজস্বের ১০ ভাগ সরকারি কোশাগারে জমা দেবেন , এক ভাগ নিজেরা ভােগ করবেন ।
- সূর্যাস্ত আইন অনুসারে বাংলা সালের হিসেবে বছরের শেষ দিনে সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বেই বাকি রাজস্ব জমা করতে হবে , না হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে ।
- অদূর ভবিষ্যতে কোনাে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেও রাজস্বের ছাড় দেওয়া হবে না ।
- জমিদাররা ভূমিরাজস্ব – সংক্রান্ত কোনাে বিবাদের বিচার করার অধিকার পাবে না ।
- ভবিষ্যতে জমিদারদের আয় বাড়লেও কোম্পানির আদায়িকৃত নির্ধারিত রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানি কিছু উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছিল । যথা —
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাজস্ব আদায় :
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পূর্বনির্ধারিত রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যে কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন ঘটায় । জমিদাররা সূর্যাস্ত আইনের হাত থেকে জমিদারি রক্ষার লক্ষ্যে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব জমা দিতে বাধ্য থাকেন । এর ফলে কোম্পানি নির্দিষ্ট সময় তার নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্পর্কে নিশ্চিত থাকত ।
অনুগত জমিদার সম্প্রদায় সৃষ্টি :
কোম্পানি চেয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে জমির নির্দিষ্ট মেয়াদ প্রদান করে একশ্রেণির জমিদার তৈরি করতে , যারা কোম্পানির প্রতি আনুগত্যশীল থাকবে । এরা বাংলায় কােম্পানির শাসনের সহযােগী হিসেবে কোম্পানি বিরােধী গণ অসন্তোষগুলির সমাধানে সাহায্য করবে বলে আশা প্রকাশ করে কোম্পানি । এ প্রসঙ্গে কর্নওয়ালিশ নিজেই বলেছিলেন — সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য এক মর্যাদাবান ও প্রভাবশালী শ্রেণির সাহায্য দরকার ।
স্থায়ী ভূমিরাজস্বের হার নির্ধারণ :
কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ভূমি রাজস্বের হার নির্ধারণ করতে চেয়েছিল । এক্ষেত্রে কোম্পানির লক্ষ্য ছিল চিরতরে ভূমিরাজস্বের হার নির্ধারণ করে দিতে পারলে বছরের শেষে আদায়িকৃত রাজস্বের পরিমাণ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা দূর হবে । আর্থিক স্থিরতা আসলে ব্রিটিশ সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিন্তে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবে ।
বাজেট তৈরি :
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল একবার ভূমিরাজস্বের হার স্থায়ীভাবে নির্ধারিত করে দিতে পারলে একদিকে যেমন বার্ষিক আয়ের পরিমাণ জানা যাবে , অপরদিকে ব্যয়ের পরিকল্পনা গ্রহণও সম্ভব হবে এককথায় বার্ষিক আয়ব্যয়ের হিসেব বা বাজেট তৈরি করতে সুবিধা হবে ।
নিলাম ব্যবস্থা থেকে মুক্তি :
রাজস্ব ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্বে মধ্যস্বত্বভােগীদের নিয়ােগ করে কোম্পানি অনেক সময় রাজস্ব সংগ্রহ করত । অনেক ক্ষেত্রে নিলাম ডাকের সময় যে অর্থমূল্য উঠত তার সম্পূর্ণ অংশ কোম্পানির ঘরে রাজস্ব হিসেবে জমা হত না । এ ছাড়াও আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ বছর বছর আলাদা হওয়ায় বা বছর বছর নিলামদার পালটে যাওয়ায় জমিদার বা রায়ত কেউই চাষের উন্নতির দিকে নজর দিত না । আবার এই ব্যবস্থায় প্রতিবছর নতুন খাজনার হার নির্ধারিত হত । নিলাম ব্যবস্থার এই ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন ।
সমালোচকদের মত
সমালােচকদের মতে , লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়ােগ ঘটিয়ে এদেশের শিল্প বাণিজ্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এ বক্তব্যের বিরােধিতা করে ড . বিনয় চৌধুরী বলেছেন , বাংলার শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের কোনাে ইচ্ছা লর্ড কর্নওয়ালিশের ছিল না । বরং তিনি মনে করতেন যে শিল্প বাণিজ্যের উন্নতির স্বার্থে কৃষির অগ্রগতি দরকার এবং জমিদাররা স্থায়ী স্বত্ব পেলে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি হবে । তবে অধ্যাপক পি . জে . মার্শালের মতে — শুধুমাত্র প্রশাসনিক প্রয়ােজনই না , রাজনৈতিক স্বার্থেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়ােজন হয় ।