সতীদাহ প্রথা কী আলোচনা করো
Contents
সতীদাহ প্রথা কী আলোচনা করো
হিন্দুনারীর জীবনে এক নিষ্ঠুর অভিশাপ ছিল সতীদাহ প্রথা । সে সময়কার সমাজে রক্ষণশীল হিন্দুরা মৃত স্বামীর বিধবা স্ত্রীকে বােঝাতেন যে , স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেলে পুণ্য অর্জন হবে এবং পরলােকে সে তার মৃত স্বামীর সাহচর্য পাবে । রামমােহন রায়ের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা রদ । তিনি বিভিন্ন গুণীজনের স্বাক্ষরিত এক আবেদনপত্রের মাধ্যমে সরকারকে জানান , মানবতাবােধ ও শাস্ত্র সকল দিক থেকে সতীদাহ নিন্দনীয় । এই কাজ নরহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয় ।

সতীদাহ প্রথার উদ্দেশ্য
সেসময়কার গোঁড়া ব্রাহ্মণদের সতীদাহ প্রথা চালু রাখার পিছনে কিছু অসৎ উদ্দেশ্য ছিল । এ ছাড়া তৎকালীন হিন্দুসমাজের কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস এই প্রথা প্রচলিত থাকার পেছনে দায়ী ছিল ।
- মৃত কুলীন পতির বহু বিধবার দায় এড়ানাের জন্য অর্থাৎ বিধবা নারীকে ভরণপােষণ করার যে ঝঞ্ঝাট বা দায়িত্ব থাকে তা থেকে উচ্চবর্ণের পরিবারগুলিকে রেহাই দিতে চাওয়া হয়েছিল ।
- সে সময়কার সমাজের নিয়ন্ত্রকগণ বিধবার সম্পত্তি গ্রাস করতে চেয়েছিল ।
- হিন্দুধর্মের সেসময়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে মৃত স্বামীর সঙ্গে বিধবাপত্নীকে একই চিতায় দাহ করতে পারলে পরলােকে গিয়ে পত্নীটি তার স্বামীর সাহচর্য পাবে ।
- সতীদাহ প্রথায় নিজের প্রাণ উৎসর্গ করলে বিধবা নারীটি সতীরূপে সারা গ্রামে পূজিতা হবেন এবং তার নামে কোনাে মনস্কামনা করলে তা পূরণ হবে — এই ভ্রান্ত বিশ্বাস মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল ।
সতীদাহ প্রথার বিবরণ
বাংলার সমাজে সতীদাহ নামে যে নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথাটি প্রচলিত ছিল , সেটি ছিল এরকম — উচ্চবর্ণের পরিবারে কোনাে বধূ স্বামীহারা হলে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় সেই বিধবা নারীটিকে নববধূর সাজে সাজিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুড়িয়ে মারা হত । জ্বলন্ত চিতায় অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সময় বিধবাটির চিৎকার যাতে অন্য কারাের কানে না পৌঁছােয় তার জন্য শ্মশানে ঢাক , ঢােল , কাঁসর – ঘণ্টা বাজিয়ে একদল মানুষ পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠত ।
সতীদাহ প্রথা রদে রামমােহনের প্রচেষ্টা
রামমােহন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ থেকে উক্তি তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে , সতীদাহ একটি ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয় কুপ্রথা । এই প্রথা বন্ধের লক্ষ্যে তিনি ৩০০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর নিয়ে বড়ােলাট বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন । রামমােহনকে এসময় সমর্থন জানিয়ে সমাচার দর্পণ , সংবাদ কৌমুদী , বেঙ্গল হরকরা , ইন্ডিয়ান গেজেট , ক্যালকাটা জার্নাল , ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পত্রপত্রিকাতেও সতীদাহ – বিরােধী লেখা প্রকাশিত হয় । রামমােহন নিজে সতীদাহ – বিরোধী এক পুস্তিকা প্রকাশ করেন (১৮১৮ খ্রি.)।
সতীদাহ প্রথা রদ
রামমােহনের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথা – বিরােধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার রেশ বেন্টিঙ্ককেও স্পর্শ করে । বেন্টিঙ্ক ১৭ নং রেগুলেশান জারি করে সতীদাহ প্রথা রদ করেন ( ১৮২৯ খ্রি . ৪ ডিসেম্বর ) । ঘােষণা করা হয় সতীদাহ প্রথা হল বেআইনি এবং তা ফৌজদারি আদালতে শাস্তিযােগ্য অপরাধ । মাদ্রাজসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে এই আইন কার্যকরী হয় । যােগেশচন্দ্র বাগল ‘ মুক্তির সন্ধানে ভারত ‘ গ্রন্থে লিখেছেন , “ রামমােহন জনসাধারণের চক্ষে সতীদাহ দমনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন । টাউন হলের এক জনসভায় তাঁকে এজন্য কলিকাতার বিশিষ্ট নাগরিকরা সম্বর্ধনা দেন । ”