রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলতে কী বোঝো

রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলতে কী বোঝো

ফরাসি শব্দ রেনেসাঁস (Renaissance) কথাটির অর্থ হল নবজাগরণ বা পুনর্জন্ম। এককথায় নবজাগরণ বলতে ভাব-বিপ্লবকে বোঝায়। ফরাসি ঐতিহাসিক মিশেলে 1855 খ্রিষ্টাব্দের রেনেসাঁস শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের ইউরোপে গ্রিক ও রোমান শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে এক উদার ও যুক্তিশীল নতুন চেতনার জন্ম হয়। যার মধ্য দিয়ে সমগ্র ইউরোপ মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনা নবজাগরণ নামে পরিচিত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা যথা- শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান এমনকি ধর্মের ক্ষেত্রেও এই নবীন ভাবধারার প্রভাব গভীরভাবে পরিলক্ষিত হয়।

download 1 4
Renaissance

মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নবজাগরণের তুলনা ও সম্পর্ক

মধ্যযুগীয় অনুদার সংস্কৃতি : 

476 খ্রিস্টাব্দে বর্বর জার্মান উপজাতির আক্রমণে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সমগ্র ইউরোপে চরম অরাজকতা নেমে আসে। এরফলে ইউরোপে প্রাচীন সংস্কৃতির চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাথলিক চার্চকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন পরিচালিত হতো। একদিকে সামন্ত প্রভুদের শোষণ অন্যদিকে চার্চের অপরিসীম প্রভুত্ব মানুষের স্বাধীন সত্তাকে বিপন্ন করে তোলে। এইভাবে মানুষ তার নিজের চিন্তা করার ক্ষমতাকে হারিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ভুলতে শুরু করে।

নতুন প্রাণের সঞ্চার : 

শীতের পর যেমন বসন্ত আসে তেমনি পঞ্চদশ শতকে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সুবাদে ইউরোপে চিন্তার জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। মানুষ তার মনের জড়ত্বকে দূর করে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিকে আশ্রয় করে। প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুশাসন সবকিছুকে যুক্তির আলোকে যাচাই করতে শুরু করে। বিজ্ঞানের আলোকে বন্যা, জল, ঝড়, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনাবলির সত্যানুসন্ধানে মানুষ উৎসাহী হয়ে ওঠে। এভাবে সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প, ভৌগোলিক আবিষ্কার প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইউরোপের মানুষের প্রতিভা ও উদ্যম ছড়িয়ে পড়ে।

রেনেসাঁস বা নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে নবজাগরণের ফলে ইউরোপের মানুষের মনোজগতে যে আলোড়ন দেখা দিয়েছিল তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির পুনর্জন্ম : 

প্রাচীন গ্রিক ও রোমের মানুষ ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করত। সেই কারণে নবজাগরণের সময় ইউরোপে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, আইন, শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চার পুনরুজ্জীবন ঘটে।

পন্ডিতদের প্রভাব : 

বিভিন চিন্তা সম্পন্ন পণ্ডিতদের প্রভাবে ইউরোপের মানুষের চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। ফলশ্রুতি হিসেবে জন্ম নেয় যুক্তিবাদ।

যুক্তিবাদের প্রভাব : 

নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিবাদ। নবজাগরণের প্রভাব মানুষের চিন্তা ও ভাবজগতে প্লাবন দেখা দেয়। যার ফলে মানুষ সবকিছুকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করতে শুরু করে।

শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব : 

নবজাগরণের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এগুলি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র পরিণত হয়।

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার : 

নবজাগরণের ফলে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। ফলে একদিকে যেমন মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানতে পারে, অন্যদিকে প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ঘটায় আর্থ-সামাজিক জীবনের রূপান্তর ঘটে।

বাণিজ্যের উন্নতি : 

নবজাগরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বাণিজ্যের প্রসার। কৃষি ও শিল্প-উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রির জন্য মানুষ দেশ-বিদেশে পাড়ি দেয়। এর ফলে বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।

ভাব বিনিময় : 

বাণিজ্যিক সূত্রে মানুষ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেওয়ার ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসে। এভাবে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে।

ধর্মীয় প্রভাব হ্রাস : 

বাণিজ্যিক সূত্রে ইউরোপের মানুষ বিভিন্ন দেশের প্রাণোচ্ছল জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া বিজ্ঞান-আগ্রহী মানুষ খ্রিস্টীয় চার্জের ভন্ডামি এবং পোপের ব্যাখ্যা যে ভুল তা জানতে পারে। এরফলে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব হ্রাস পায়।

সাংস্কৃতিক উন্নতি : 

নবজাগরণের দুই মূল স্তম্ভ ー সাহিত্যশিল্পের ক্ষেত্রে উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাপক সাহিত্যচর্চার ফলে আঞ্চলিক ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

রেনেসাঁস বা নবজাগরণের প্রেক্ষিত বা পটভূমি

ইউরোপের নবজাগরণ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বহুদিনের প্রস্তুতির ফসল।

মধ্যযুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবদান : 

প্রকৃতপক্ষে নবজাগরণের ভিত্তি রচিত হয়েছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে থেকে। একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে গড়ে ওঠে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতালির সালোনা বলোনা বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একদল পন্ডিতের আবির্ভাব ঘটে 一 যাঁরা ‘স্কুলম্যান‘ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে ফরাসি পণ্ডিত  অ‍্যাবেলার্ড, ইতালির দার্শনিক ইরনেরিয়াস, টমাস অ‍্যাকুইনাস, অ্যালবার্ট ম্যাগনাস, প্যারিস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার বেকন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এরা ধর্মীয় তত্ত্ব ও সামাজিক রীতিনীতিকে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা করার প্রথম চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল 一 গ্রীক দর্শন, জাস্টিনিয়ান আইন, আরবীয় গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি। এর ফলে ইউরোপের মানুষের মধ্যে প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সংযমের অভাবে ঘটে। একই সঙ্গে পঞ্চদশ শতকে ইতালিতে আগত মনীষীদের সাহচর্যে এই যুক্তিশীল চেতনা আরো গভীর হয়ে ওঠে এবং ক্রমে তা আন্দোলনে রূপ নেয়। সুতরাং বলা যায়, মধ্যযুগের গর্ভেই লালিত হয়েছিল এই নবজাগরণ

কনস্টান্টিনোপলের পতন : 

1453 খ্রিস্টাব্দে তুর্কি আক্রমণে কনস্টান্টিনোপলের পতন নবজাগরণের বিকাশের পথ আরও সুগম করে। 476 খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর কনস্টান্টিনোপল ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান। কিন্তু কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর সেখানকার জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতেরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে পশ্চিম ইউরোপের ইটালির বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ ইটালির বন্দর ও শহরগুলির মুক্ত পরিবেশে পণ্ডিতেরা তাঁদের সাংস্কৃতিক চর্চা শুরু করেন। এভাবে নবজাগৃতি আন্দোলন ব্যাপক রূপ নেয়। সেই কারণে ঐতিহাসিকরা 1453 খ্রিস্টাব্দকে নবজাগরণের সূচনাবর্ষ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

উত্তর ইটালিতে নগর ও বাণিজ্য

ইউরোপের মধ্যে ইটালিতেই প্রথম নবজাগরণ পূর্ণতালাভ করে।

উত্তর ইটালির নগর : 

ভূমধ্যসাগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় উত্তর ইটালির শহরগুলি ক্রুসেডের সময় থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। বাণিজ্যিক সূত্রে আরবীয় মুক্ত প্রাণোচ্ছল সংস্কৃতি ইটালির বিভিন্ন শহরগুলিতে প্রবেশ করে। ফ্লোরেন্স, মিলান, ভেনিস, জেনোয়া প্রভৃতি শহরগুলির মুক্ত পরিবেশ চিন্তাশীল মনীষীদের জ্ঞানচর্চার সহায়ক ছিল।

কনস্টান্টিনোপলের পতন : 

আগেই বলা হয়েছে, তুর্কিদের আক্রমণে কনস্টান্টিনোপলের পতন হয় ও সেখানকার নিরাশ্রয় যুক্তিশীল, মানবধর্মী মনীষীগণ ইটালির মুক্ত পরিবেশে আশ্রয় নেন। এভাবে ইটালির বিভিন্ন বন্দর-শহরগুলি সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়। মানসিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সেখানকার নবীন বণিক গোষ্ঠী হলেন এই পণ্ডিতদের প্রধান সহায় এবং নতুন সংস্কৃতির মুখ্য বাহক।

ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার : 

ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ফলে ইটালিতে সম্পদশালী বণিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এই বণিক গোষ্ঠী বরাবরই ব্যবসা-বাণিজ্যে উৎসাহী ছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফ্লোরেন্সের মেদিচি পরিবার। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ মেদিচি পরিবারের কসিমো এবং লরেঞ্জো দ‍্য মেদিচি  ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও শিল্পরসিক। চার্চ-নিয়ন্ত্রিত ও ধর্মীয় কঠোর জীবন যাত্রার পরিবর্তে বর্তমান জীবনকে আনন্দময় করে তোলার জন্য তাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সে কারণে ফ্লোরেন্সে প্রথম নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে,  ফ্লোরেন্স হয়ে ওঠে ‘দ্বিতীয় এথেন্স‘।

মুদ্রণ-বিপ্লব :

পঞ্চদশ শতকে আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কারের ফলে মুদ্রণ-জগতে বিপ্লব ঘটে। প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন পুস্তক এবং বাইবেল বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় মুদ্রিত হলে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। মুদ্রণ-বিপ্লব নবজাগরণকে গতিদান করে

শিক্ষাব্যবস্থা :

একাদশ-দ্বাদশ শতকে ইটালির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাঠ্যসূচিতে আরবীয় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, রোমান আইন প্রভৃতির চর্চা ব্যাপকভাবে হতে থাকে। আরবীয়দের আনন্দময় জীবনযাত্রা  ইটালীয়দের বিজ্ঞান-সচেতন ও জীবনমুখী করে তুলেছিল। এর ফলে নবজাগরণ আরও গতিশীল হয়ে ওঠে।

নবসংস্কৃতির প্রসার :

ফ্লোরেন্সে আত্মপ্রকাশ করলেও নতুন সংস্কৃতির ধারা ধীরে ধীরে ইটালির রোম, মিলান, ভেনিস, জেনোয়া প্রভৃতি শহরে প্রবাহিত হতে থাকে। তারপর আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করে এই নবসংস্কৃতির ঢেউ আছড়ে পড়ে জার্মানি, নেদারল্যান্ড, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। এভাবে ইটালি থেকে সমগ্র ইউরোপে নবজাগৃতি আন্দোলন বিকাশ লাভ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!