অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল/প্রভাব
Contents
অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল/প্রভাব
অবশিল্পায়ন শব্দটি শিল্পের অধঃপতনকেই বােঝায় । অবশিল্পায়ন হল শিল্পায়নের বিপরীত প্রক্রিয়া । অর্থাৎ শিল্পের ধ্বংসসাধন । ডেনিয়েল থর্নারের মতে — শিল্পে নিয়ােজিত জনসংখ্যার ক্রমহ্রাসমানতা হল অবশিল্পায়ন । ( ‘…a decline in the proportion of the working population engaged in secondary industry ’) ।

অবশিল্পায়নের কারণ
অবশিল্পায়নের কারণ নিয়ে মতবিরােধ থাকলেও এর সর্বজনগ্রাহ্য কয়েকটি কারণ ছিল —
মূলধনের অভাব :
আঠারো শতকে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার ঘটিয়ে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটানাে সম্ভব হয়েছিল মূলধনের জোগান থাকায় । কিন্তু ভারতে মূলধনের জোগান দেওয়া তাে দূরের কথা এদেশের অর্থ ও সম্পদকে কোম্পানি নিংড়ে শােষণ করে নিয়েছিল । ফলে মূলধনের অভাবে অবশিল্পায়ন ছিল এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ।
অবাধ বাণিজ্যনীতি :
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের মাধ্যমে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের অবসান ঘটিয়ে অবাধ বাণিজ্যনীতি গৃহীত হয় । ফলে ইংল্যান্ডের অন্যান্য বণিক সম্প্রদায়ও এবার থেকে অবাধে ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত কৃষিনির্ভর পণ্যসামগ্রীতে ভারতীয় বাজার ছেয়ে যায় ।
কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য :
বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানি ব্রিটিশ বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটায় । দেওয়ানি লাভের পর শুরু হয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের যুগ । অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘ Wealth of Nation ‘ গ্রন্থে লিখেছেন — ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশ বাণিজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ও ভারতীয় স্বার্থবিরােধী ।
শিল্প বিপ্লব :
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে যাওয়ায় অনেক কম সময়ে বেশ উন্নতমানের অথচ সস্তা দ্রব্য উৎপাদন শুরু হয় , যা সহজে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজার দখল করে নেয় । এ প্রসঙ্গে ড . রমেশচন্দ্র দত্ত বলেছেন — ইউরােপের পাওয়ার লুমের আবিষ্কার ভারতীয় শিল্পের বিনাশকে সম্পূর্ণ করেছিল ( ‘ The Invention of Powerloom in Europe Completed the decline of the Indian Industries ‘ ) ।
অসম শুল্ক নীতি :
কোম্পানি নিজে বিভিন্ন পণ্যের ওপরে শুল্ক ছাড়ের সুযােগ নিলেও ভারতে উৎপাদিত শিল্পপণ্য এবং দ্রব্যগুলির ওপর বিশাল শুল্কের বােঝা চাপায় । ইংল্যান্ড থেকে আগত শিল্পদ্রব্যগুলির ওপর কোনাে কর না চাপানােয় শিল্পপণ্যের দামের ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতায় ভারতীয় শিল্পবণিকরা পিছিয়ে পড়তে থাকে ।
ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের ধ্বংসসাধন :
ভারতে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের সুতিবস্ত্র ইংল্যান্ড ও ইউরােপের প্রত্যেক দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল । এ প্রসঙ্গে ড্যানিয়েল ডেফো ‘রবিনসন ক্রুশাে ‘ গ্রন্থে লিখেছেন — ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে , বসার ঘরে , শােবার ঘরে , সবজায়গায় ভারতীয় বস্ত্র ঢুকে পড়েছে । তা দেখে ব্রিটিশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে ও ভারত থেকে ব্রিটেনে রপ্তানিকৃত সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক চাপায় । এর ফলে ব্রিটেনে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের চাহিদা কমে যায় ও দেশীয় বস্ত্রশিল্পের ধ্বংসসাধন ঘটে ।
উপসংহার :
অবশিল্পায়নের আরও কয়েকটি কারণ ছিল । স্বাধীন শিল্পসংস্থার অনুপস্থিতি , দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতার অভাব, মােগল সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা , কোম্পানির কুঠিয়াল – গােমস্তাদের অত্যাচার ইত্যাদি অবশিল্পায়নে ইন্ধন জোগায় ।
অবশিল্পায়নের ফলাফল / প্রভাব
ব্রিটিশ ভারতে অবশিল্পায়নের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী —
কর্মহীনতা :
অবশিল্পায়নের ফলে ভারতীয় হস্তশিল্পী এবং কারিগরশ্রেণি কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে । কারিগর ও শিল্পীরা পৈতৃক কাজ ছেড়ে কৃষিক্ষেত্রে ভিড় জমায় । অনেক জায়গাতেই কুটিরশিল্পের বিকল্প হিসেবে যন্ত্র নির্ভর কলকারখানা গড়ে না ওঠায় প্রচুর মানুষ বেকার হয়ে পড়ে । নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মতে , শুধু বাংলাতেই ১০ লক্ষ লােক জীবিকা হারিয়েছিল ।
কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন :
যন্ত্রশক্তিচালিত ব্রিটিশ মিলগুলিতে উৎপাদিত সস্তা পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে প্রতিযােগিতায় দেশীয় হস্তশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী পিছিয়ে পড়ে । ফলে কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন সম্পূর্ণ হয় ।
শহরগুলির শ্রীহীনতা :
অবশিল্পায়নের ফলে ঢাকা , মুর্শিদাবাদ , সুরাটসহ বিভিন্ন শহর জনবিরল হয়ে পড়ে । ভারতীয় মসলিনের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা শহরের জনসংখ্যা এসময় অর্ধেক কমে যায় । মুর্শিদাবাদের কোম্পানির রেসিডেন্ট মি. বেচার এ প্রসঙ্গে বলেছেন , “ আমাদের অপশাসনের ফলে কুড়ি বছরের মধ্যে দেশের বহু জায়গা প্রায় মরুভূমির রূপ ধারণ করেছে । “
কাঁচামাল সরবরাহের দেশে রুপান্তর :
অবশিল্পায়নের মাধ্যমে ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছিল কাঁচামাল সরবরাহের দেশে । ভারত থেকে কাঁচা রেশম , নীল , চা , কাঁচা তুলাে প্রভৃতি ব্রিটেনের কলকারখানাগুলিতে সরববাহ শুরু হয় । পরাধীন উপনিবেশগুলি থেকে কাঁচামাল নিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ডে কারখানা গড়ে তােলার সমালােচনা করে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তাঁর ‘ On colonialism ‘ গ্রন্থে লিখেছেন ইংল্যান্ড হবে পৃথিবীর কারখানা আর তার পদানত দেশগুলি হবে তার কৃষিলেজুর ( agrarian appendage ) ।
চিনি শিল্পের ক্ষতিসাধন :
বিহার ও বারাণসীর চিনি কেন্দ্রগুলির উৎপাদিত চিনি কলকাতা বন্দর হয়ে ব্রিটেনে রপ্তানি হত । এক্ষেত্রে এর শুল্ক ও পরিবহন খরচ ছিল এমনিতেই বেশি । তার ওপর ব্রিটিশ চিনি শিল্পের ওপর তিনগুণ বেশি কর চাপায় । এর ফলে , আন্তর্জাতিক প্রতিযােগিতায় ভারতীয় চিনি শিল্প পিছিয়ে পড়ে ।
জাহাজ শিল্পের ধ্বংসসাধন :
রামদুলাল দে , রামগােপাল মল্লিক , মদন দত্ত , পাঁচু দত্ত প্রমুখ বাঙালি জাহাজ মালিকদের উদ্যোগে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল । কিন্তু ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের কর্তৃপক্ষ ভারত – ব্রিটেন বাণিজ্যে দেশীয় জাহাজ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করলে জাহাজ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হয় । এছাড়া সরকারি তরফে বাষ্পীয় পােতের অনুপ্রবেশ এবং জাহাজ নির্মাণ রীতিতে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরােপ করা হলে জাহাজ শিল্পের ধ্বংসসাধন ঘটে।
সূক্ষ্ম ও শৌখিন শিল্পের অবলুপ্তি :
দেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতায় , দেশীয় রাজ্যগুলি শৌখিন শিল্প ও সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়ের উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল । কিন্তু কোম্পানি দেশীয় রাজ্যগুলি দখল করে নিলে এবং সেগুলিকে বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত করলে সূক্ষ্ম ও শৌখিন শিল্পের অপমৃত্যু ঘটে ।
উপসংহার :
অবশিল্পায়নকে বহু সমালােচক , গবেষক ‘ অলীক কল্পনা ‘ বলে উল্লেখ করেছেন । অবশিল্পায়ন ‘ অলীক কল্পনা ‘ কি না এ নিয়ে ডেনিয়েল থর্নার , মরিস ডেভিড মরিস , স্যার থিওডাের মরিসন প্রমুখের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে । মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস বলেছেন , অবশিল্পায়নের ধারণা জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের প্রচারিত এক অলীক কল্পনা ( myth ) । কিন্তু ড . সব্যসাচী ভট্টাচার্য , ড . অমিয় বাগচি , ড . তপন রায়চৌধুরী , ড . বিপান চন্দ্র প্রমুখ মনে করেন অবশিল্পায়ন একটি বাস্তব ঘটনা এবং তা ভারতবাসীকে দুঃখদুর্দশার তিমিরে নিক্ষেপ করেছিল ।
Thank you very much
👍👍👍