সম্পদের নির্গমন বলতে কী বোঝো
Contents
সম্পদের নির্গমন বলতে কী বোঝো
পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা ও ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকে কোনাে প্রতিদান ছাড়াই বিপুল পরিমাণ অর্থ , বিভিন্ন পণ্য ও উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ইংল্যান্ডে চালান করেছিল । এই ঘটনাটিই ঐতিহাসিক ও সমালােচকদের মতে সম্পদের নির্গমন বা অর্থনৈতিক নিষ্ক্রমণ ( Economic Drain ) নামে পরিচিত । এ প্রসঙ্গে কোম্পানির মাদ্রাজের রাজস্ব – সচিব জন সুলিভ্যান লিখেছেন — আমাদের শাসনব্যবস্থা অনেকটা স্পঞ্জের মতাে , গঙ্গা তীরবর্তী দেশ থেকে এই স্পঞ্জধর্মী শাসন যা কিছু সম্পদ সব শুষে নেয় এবং টেমস তীরবর্তী দেশে এনে তা নিংড়ে দেয় ।

সম্পদের নির্গমনের বিভিন্ন মতামত
দাদাভাই নওরােজি , রমেশচন্দ্র দত্ত সম্পদের বহির্গমনকে ‘ Drain of Wealth ‘ বলে উল্লেখ করেছেন , অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অম্লান দত্ত Economic Drain – এর বাংলা অর্থ ‘অপহার’ বলে উল্লেখ করেছেন । অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য সম্পদের নির্গমনকে ‘ ধন নির্গম ’ , ‘ ধন নিগর্মন ‘ , ‘ ধন নিঃসরণ ‘ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন । ড. পার্সিভাল স্পিয়ার পলাশি পরবর্তী যুগকে প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ বলে অভিহিত করেছেন ।
সম্পদের নির্গমনের সময়কাল
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর থেকেই কোম্পানি বিভিন্নভাবে সম্পদের নির্গমন ঘটাতে শুরু করে । কার্ল মার্কস ‘ দাস ক্যাপিটালের ’ প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন যে — ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৬ মিলিয়ন পাউন্ড শুধু উপহার বাবদ ভারতের বাইরে চালান দেওয়া হয় ।
সম্পদের নির্গমনের পদ্ধতি
আর্থিক নিষ্ক্রমণ ঘটেছিল দুটি পদ্ধতিতে —
- কোম্পানির কর্মচারী ও বণিকদের মাধ্যমে
- কোম্পানির বাণিজ্য অর্থনীতি ও রাজস্বনীতির মাধ্যমে
- এই দুটি পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পাচার করা হয়েছিল ।
নবাব তৈরির মাধ্যমে :
পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর কোম্পানি নবাব তৈরির খেলায় কোটি কোটি টাকা লাভ করে । বাংলার সিংহাসনে একের পর এক নবাব বসিয়ে কোম্পানি এই অর্থ লুণ্ঠন করে ।
উৎকোচ ও উপঢৌকনের মাধ্যমে :
কোম্পানির কর্মচারীরা উৎকোচ , উপঢৌকন , পারিতােষিক , নজরানা বাবদ লাভ করা প্রায় ৫০ কোটি টাকা ইংল্যান্ডে পাঠায় । রেজা খাঁকে নায়েব – নাজিম পদ দেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানি চার লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার টাকা উপঢৌকন গ্রহণ করে ।
উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দ্বারা :
ক্লাইভ , জনস্টন , সিনিয়র , সাইকস প্রমুখ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ খালি হাতে এদেশে এসে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান । এইসব কর্মচারীরা স্বনামে ও বেনামে ব্যক্তিগত বাণিজ্য , বিনিয়ােগ ( ইনভেস্টমেন্ট ) ও সরাসরি কর আরােপের মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ লুণ্ঠন করেন ।
কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে :
গভর্নর জেনারেল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এমনকি কর্মচারীরা পর্যন্ত স্বনামে বেনামে সাঁকো তৈরি , বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদির কনট্রাক্ট নিয়ে প্রচুর টাকা রােজগার করেন ।
হোমচার্জ দ্বারা :
কোম্পানির যাবতীয় কাজ পরিচালনার জন্য ইংল্যান্ডে যে খরচ হত তা ভারত থেকে উশুল করে নেওয়া হত । এই খরচ হােমচার্জ নামে পরিচিত ।
মন্তব্য
বিভিন্ন পদ্ধতিতে সম্পদের নির্গমন ব্রিটিশের ভারত শােষণের মানসিকতাকেই প্রকাশ করে । ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারেট তাই ব্রিটিশের এই নির্গমন তত্ত্বের সমালােচনা করে বলেছেন — বাংলা ছিল একটি টাকার গাছ ( Pagoda Tree ) , যাকে নাড়া দিলে টাকা কুড়ােনাে যায় ।