পলাশীর লুণ্ঠন বলতে কী বোঝো
পলাশীর লুণ্ঠন বলতে কী বোঝো
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অর্থ ও সম্পদকে দু – হাত ভরে ভারত থেকে নিজের দেশ ইংল্যান্ডে পাচার করেছিল । বিদেশি ইংরেজরা সােনা , রুপা বা কোনাে পণ্যসামগ্রীর বিনিময়ে এই সম্পদের নির্গমন ঘটায়নি , তাই এই ঘটনাকে অনেকে লুণ্ঠন বলে উল্লেখ করেছেন । ব্রুকস অ্যাডামস আর্থিক নির্গমনের এই ঘটনাকে ‘ পলাশীর লুণ্ঠন ‘ বা ‘Plassey Plunder’ বলে অভিহিত করেছেন । পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের মতে — পলাশীর পরবর্তী যুগ হল ‘ প্রকাশ্য নির্লজ লুণ্ঠনের যুগ ‘ । ( ‘… Age of open and unashamed plunder ‘ ) ।

লুণ্ঠনের ধারা
পলাশীর লুণ্ঠন ঘটেছিল দুটি ধারায় । প্রথমটি হল, বেসরকারিভাবে কোম্পানির কর্মচারীদের মাধ্যমে । দ্বিতীয়টি, কোম্পানির বাণিজ্যনীতি , অর্থনীতি ও রাজস্বনীতির মাধ্যমে । এই দুই পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ভারত থেকে ইল্যান্ডে পাচার করা হয়েছিল ।
লুণ্ঠনের বর্ণনা
রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন পলাশীর লুণ্ঠনের পথপ্রদর্শক । এসময়ে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীরা প্রায় ৫০ কোটি টাকা ভারত থেকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ।
পলাশীর যুদ্ধে জেতার পর কোম্পানি নবাব কেনাবেচার খেলায় নেমেছিল । পূর্বপ্রতিশ্রুতি – মতাে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে কোম্পানির কর্মচারীরা পেয়েছিলেন প্রায় দেড় কোটি টাকা । ক্লাইভ নিজে পেয়েছিলেন ২৭ লক্ষ টাকা নগদ এবং উপটৌকন হিসেবে পেয়েছিলেন বার্ষিক ৩০ হাজার পাউন্ড – বিশিষ্ট একটি জায়গির ।
রেজা খাঁ -কে নায়েব-নাজিম পদ প্রদানের বিনিময়ে কোম্পানি ৪ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা উপঢৌকন গ্রহণ করে ।
মিরকাশিমকে বাংলার মসনদে বসিয়ে গভর্নর ভ্যান্সিটার্টসহ কলকাতা কাউন্সিলের সদস্যরা পেয়েছিলেন ৩২ লক্ষ ৭৮ হাজার টাকা ।
মিরজাফরের ছেলে নজম্ – উদদৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা ৬২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ভেট পেয়েছিলেন । পলাশীর লুণ্ঠনের ঠগের নায়ক রবার্ট ক্লাইভ , জনস্টন , সিনিয়র , সাইকস প্রমুখ শুন্যহাতে ভারতে এসে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে নিজেদের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরেছিলেন ।
লুণ্ঠনের বিভিন্ন মত
পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে ভারত থেকে ঠিক কতটা পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ইল্যান্ডে পাচার হয়েছিল তার সঠিক পরিমাণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে । যােগেশচন্দ্র সিংহের মতে — এই নির্গমনের পরিমাণ ( ১৭৫৭ – ৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ) ৩৮ কোটি ৪ লক্ষ পাউন্ড , স্যার পি. জে. গ্রিফিথের মতে — ১৭৮০ – ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই পরিমাণ ৩০ কোটি পাউন্ড , হােল্ডেন ফার্বারের মতে — ১৭৮৩ – ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর পরিমাণ ১৮ লক্ষ পাউড , অধ্যাপক পি . জে . মার্শালের মতে এর পরিমাণ বার্ষিক ৫ লক্ষ পাউন্ড । ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে — ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাৎসরিক গড়ে ২৫ – ৩০ লক্ষ টাকা বাংলা থেকে নির্গমন হয় ।
পলাশীর লুণ্ঠনের ফলাফল
ভারত থেকে লুণ্ঠিত অর্থের সাহায্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের প্রশাসনিক খরচ চালাত । ভারতে তারা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল এই অর্থের সাহায্যেই । মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনী পামদত্ত লিখেছেন , ভারতের সম্পদ দিয়েই আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্থে আধুনিক ইংল্যান্ড গড়ে উঠেছিল । এদেশের পাচার করা অর্থকে কাজে লাগিয়ে শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছিল ইংল্যান্ড , আর অপরদিকে ভারতবাসীর সুখশান্তি নষ্ট হয়েছিল এবং তারা দুঃখের সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছিল । তাই কার্ল মার্কস লিখেছেন — অ্যালকেমিস্টদের ( যারা কৃত্রিম সােনা তৈরি করতে পারে ) চেয়েও ধূর্ত এই প্রিয়পাত্ররা ( ইংরেজরা ) শূন্য থেকে সােনা তৈরি করতে পারত ।