ইতিহাস

ভারতে সাম্প্রদায়িকতার কারণ গুলি আলোচনা করো

Contents

ভারতে সাম্প্রদায়িকতার কারণ গুলি আলোচনা করো

ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উৎস ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে । কারও মতে ব্রিটিশের ‘ বিভাজন ও শাসন নীতি ’ , কেউ মনে করেন ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কুফল হল ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বিকাশের কারণ । আবার কেউ বা হিন্দু – মুসলমানের আলাদা স্বার্থচিন্তাই সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের কারণরূপে চিহ্নিত করেছেন । আসলে সাম্প্রদায়িকতা হল এমন এক মতাদর্শ যার ওপর ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরিচালিত হয় । জওহরলাল নেহরুর  মতে — কখনও ভুললে চলবে না , ভারতের সাম্প্রদায়িকতা হল একটি পরবর্তীকালের ঘটনা যা আমাদের চোখের সামনে বিকশিত হয়েছে ( ‘ One must never forget that communalism India is a latter day phenomenon which has grown up before our eyes ‘ ) ।

communalism 6 638 1
সাম্প্রদায়িকতার কারণ

ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বিকাশের কারণ

ব্রিটিশ সরকারের বিভেদ নীতি : 

ব্রিটিশ বিভেদ নীতির প্রয়ােগ ঘটিয়ে হিন্দু – মুসলিম ঐক্যে গড়ে ওঠা জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়ে এদেশে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে চেয়েছিল । সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকেই  ব্রিটিশ শুরু করে হিন্দু তোষণ , যদিও কিছু সময়ের পর থেকেই শুরু হয় ব্রিটিশের মুসলিম তোষণ । কখনো হিন্দুদের , কখনো মুসলিমদের কাছে টেনে এনে বা দূরে সরিয়ে দিয়ে ব্রিটিশ তার সাম্রাজ্যবাদী   কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখতে চেয়েছিল । ভূদেব মুখােপাধ্যায়  তাঁর ‘সামাজিক প্রবন্ধ ‘তে লেখেন — “ ইংরেজ কৌশল করিয়া কখনও মুসলমান অপেক্ষা হিন্দুদের একটু অধিক আদর করেন এবং যখন হিন্দু আদরে ভুলিয়া যায় , তখনই আবার মুসলমানদের দিকে বিলক্ষণ ঝোঁক দেন । ”

অসম উন্নয়ন : 

ভারতে ব্রিটিশ -শাসন প্রতিষ্ঠার পর এদেশে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে চালানাের লক্ষ্যে ইংরেজি জানা কর্মচারী তৈরির জন্য ব্রিটিশ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করে । হিন্দুরা একচেটিয়াভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করে তুললেও মুসলিম সমাজ তা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে । ফলস্বরূপ সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযােগসুবিধা কাজে লাগিয়ে হিন্দুরা নিজেদের উন্নতি ঘটালেও মুসলিমরা তা পারেনি । এই অসম উন্নয়ন সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে মদত দেয় ।

ধর্মীয় বিভেদ : 

ধর্মীয় বিভেদের জন্যই হিন্দু – মুসলমান দীর্ঘস্থায়ীভাবে এক হতে পারেনি । রীতিনীতি , আচার -অনুষ্ঠান , চালচলন , আদবকায়দা , ভাষা ও সাহিত্য , খাদ্য ও বেশভূষা ইত্যাদি বহু বিষয়েই হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে অনেকটা মিল থাকলেও ধর্ম তাদের এক হতে দেয়নি । রবীন্দ্রনাথের মতে — “ হিন্দুর কাছে মুসলমান অশুচি এবং মুসলমানের কাছে হিন্দু কাফের । এই মনােভাব উভয়কে এক হতে দেয়নি ।” ভারত – সচিব লর্ড ক্রস ( ১৮৮৭ খি.) বড়ােলাট লর্ড ডাফরিনকে বলেন — ভারতীয়দের ধর্মগত বিভেদ আমাদের পক্ষে লাভজনক হবে ।

মুসলমানদের প্যান ইসলাম আদর্শ :

ভারতীয় প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত মুসলিমরা প্যান ইসলাম বা বিশ্বজোড়া  ইসলামীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন । বহু মুসলিম ভারতে বাস করলেও ভারতবর্ষকে নিজের দেশ বলে মেনে নিতে পারেননি । ভারতের থেকেও আরব , ইরাক , সিরিয়ার মতাে মুসলমান দেশগুলির সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাই তাঁদের কাছে বেশি জরুরি ছিল । ভারতের স্বাধীনতা অপেক্ষা তুরস্কের সুলতান ‘ খলিফা ’ র মর্যাদা রক্ষায় তারা বেশি সচেষ্ট ছিলেন । ফলে মুসলিমদের এই আদর্শ ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছিল । আগা খাঁ তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন — আমরা যে জাতির ভেতরে জাতি—তা সরকারকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে হবে ।

ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কুফল :

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলি সমানভাবে অথনৈতিক উন্নয়নের সুযােগ পায়নি । শিল্পায়নের অভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটে । আর ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে হিন্দুদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকায় মুসলিমরা সমাজে আর্থিক দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে । এই আর্থিক বৈষম্য সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে সাহায্য করে ।

হিন্দু জাতীয়তাবাদ : 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই প্রাচীন ভারতের সাহিত্য – সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জাগরণ শুরু হয় । দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্যসমাজ ( ১৮৭৫ খ্রি. ) ও শুদ্ধি আন্দোলন , বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু হিন্দুত্ববাদী সাহিত্য , তিলকের শিবাজি ( ১৮৯৫ খ্রি. ) বা গণপতি ( ১৮৯৪ খ্রি. ) উৎসব ইত্যাদি মুসলমানদের সন্দিগ্ধ করে তােলে ।

বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান : 

ব্যাবসাবাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটলে হিন্দু বুর্জোয়াদের উত্থান ঘটে । এর পাশাপাশি উদীয়মান মুসলিম বুর্জোয়ারা মিশর ও তুরস্কের বুর্জোয়া শ্রেণির কার্যকলাপের প্রতি আকৃষ্ট হন । এ সময়কার অভিজাত মুসলিমরা ছিলেন জমিদার সম্প্রদায়ভুক্ত । জমির সঙ্গে এই মুসলিমদের স্বার্থ জড়িয়ে থাকায় এই শ্রেণি ব্যাবসাবাণিজ্য বা শিল্পের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি । কিন্তু যখন ব্যাবসাবাণিজ্য ও শিল্পের কল্যাণে হিন্দু বুর্জোয়াদের দ্রুত উত্থান ঘটল , তখন অভিজাত মুসলিম জমিদারশ্রেণি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল । এই শ্রেণিগত বৈষম্য পরােক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে মদত দিল ।

বঙ্গভঙ্গে ব্রিটিশের ভূমিকা : 

কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সময় হিন্দু -মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে । এই সম্পর্কের অবনতিতে ব্রিটিশের দায়িত্ব অস্বীকার করা চলে না । বঙ্গভঙ্গ চলাকালীন ব্রিটিশ সরকার পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে উসকে দিয়ে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনায় মুসলিমসমাজের সমর্থন পেতে চেয়েছিল । যদিও গুটিকয়েক মুসলমান বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিলেন , কিন্তু বেশিরভাগ মুসলমানের চোখে স্বদেশি আন্দোলন ছিল এক হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ।

মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা : 

মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের আশা – আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়ােজনের কথা সরকারের কাছে ব্যক্ত করতে গঠিত হয় মুসলিম লিগ । এর পালটা পদক্ষেপরূপে মুসলিম লিগের দাবিগুলির বিরোধিতা করার জন্য গঠিত হয় হিন্দু মহাসভা । হিন্দু মহাসভার কর্মসূচিগুলি এবং মুসলিম লিগের মুসলিম উন্নয়নের প্রচেষ্টা হিন্দু – মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্ককে বিষিয়ে তােলে ।

সৈয়দ আহমেদের ভূমিকা : 

সৈয়দ আহমেদ খান ভারতীয় মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে ভারতের ঐক্য ও সংহতির সর্বনাশসাধন করেন । সৈয়দ আহমেদ মুসলিমদের বুঝিয়েছিলেন ভারতে হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি , তাই তাদের স্বার্থও আলাদা । তিনি মুসলমানসমাজকে কংগ্রেস অপেক্ষা ব্রিটিশের প্রতি বেশি ভরসা করার উপদেশ দেন । তাঁর খােলাখুলি হিন্দুবিদ্বেষ নীতি ভারতে ‘ দ্বিজাতিতত্ত্ব ’- র জন্ম দেয় এবং সাম্প্রদায়িকতার সূচনা ঘটায় ।

উপসংহার

সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে যেভাবে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় নিজেদের এক সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল  তাতে আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভারতের জাতীয় আন্দোলন । বিনষ্ট হয়েছিল ভারতের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি । সাম্প্রদায়িকতাবাদ ভারতীয় রাজনীতিতে এমন এক প্রধান সমস্যা , যার সমাধান প্রাকস্বাধীনতা পর্বে , এমনকি স্বাধীনোত্তর ভারতেও হয়নি । অধ্যাপক বিপান চন্দ্রের  মতে — সাম্প্রদায়িকতা একটি আধুনিক ব্যাপার , এর শিকড় রয়েছে আধুনিক ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক , রাজনৈতিক কাঠামাের মধ্যে ( ‘Communalism is a modern phenomenon . It has its roots in the modern colonial socio-economic , political structure ‘ ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!