মুসলিম লীগ গঠনের পটভূমি ও তাৎপর্য আলোচনা করো
মুসলিম লীগ গঠনের পটভূমি ও তাৎপর্য আলোচনা করো
সিমলা দৌত্যের ( ১৯০৬ খ্রি. ) সাফল্য ভারতীয় মুসলমান নেতাদের নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার জন্য পৃথক একটি সর্বভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিল । এরই পরিণতি হিসেবে ১৯০৬ – এর ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহের উদ্যোগে মুসলিম লীগের জন্ম হয় । তবে এটি ছিল এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল ।

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
সৈয়দ আহমেদের অনুগামীদের উদ্যোগ :
সৈয়দ আহমেদের মৃত্যুর ( ১৮৯৮ খ্রি. ) পর তাঁর অন্যতম দুই ঘনিষ্ঠ অনুগামী ভিকার – উল্ – মুলক ও মহসিন- উল্ – মুলক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মুসলিম – স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি পৃথক রাজনৈতিক সংস্থা গঠনের কথা চিন্তা করেন । এই উদ্দেশ্যে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাঁরা লক্ষ্ণৌতে এক ঘরােয়া বৈঠকে মিলিত হন । তবে তাঁদের এই প্রথম প্রয়াস বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি ।
ভিকার-উল-মুলক – এর পত্র :
১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে সাহারানপুরে একটি মুসলিম প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল বলে জানা যায় । তবে ওই বছরের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল অক্টোবর মাসে পাইওনিয়ার পত্রিকার সম্পাদককে লেখা নবাব ভিকার – উল – মুলক – এর একটি পত্র । ওই পত্রে নবাব লেখেন , সংখ্যালঘু হিসেবে ভারতীয় মুসলিমদের নিজস্ব চাহিদাগুলি সরকারের কাছে উপস্থাপন করার জন্য কতকগুলি উপায় অবশ্যই বার করতে হবে । এইভাবে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মুসলিমসমাজ আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় ।
রাজনৈতিক দল গঠনের দাবি :
সিমলা দৌত্যের প্রাক্কালে মুসলিম নেতৃবৃন্দ লক্ষ্ণৌতে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে ( ১৬ সেপ্টেম্বর , ১৯০৬ খ্রি. ) নিজ সম্প্রদায়ের জন্য একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গভীরভাবে আলােচনা করেন । পরে ১ অক্টোবর সিমলা দৌত্যে মুসলিম প্রতিনিধিবর্গ বিষয়টি গুরুত্বসহকারেই লর্ড মিন্টোর কাছে উত্থাপন করেন । এই দৌত্য প্রসঙ্গে আগা খাঁ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন — সিমলা বৈঠকে যােগদানকারী মুসলিম নেতারা এ বিষয়ে একমত হয়েছিলেন যে , একটি স্বতন্ত্র সংগঠন ও সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থার ওপরেই তাঁদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ।
মুসলিম লীগ গঠন :
অবশেষে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর নবাব ভিকার – উল – মুলক – এর সভাপতিত্বে প্রায় আট হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঢাকায় ‘ মহামেডান শিক্ষা সম্মেলন ’ – এ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় । আগা খাঁ লিগের প্রথম সভাপতি এবং মহসিন – উল্ – মুলক ও ভিকার – উল – মুলক যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য / প্রভাব / গুরুত্ব
মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ভারতে যে সাম্প্রদায়িক ভেদ নীতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ এর জন্ম দিয়েছিল তাতে ভারতীয় জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় রাজনীতিতে তথা ভারত ইতিহাসে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল তার বিষময় পরিণতি হিসেবে ১৯৪৭ সালে ভারত ব্যবচ্ছেদ ঘটে।
সাম্প্রদায়িক ঐক্যে প্রতিবন্ধকতা :
মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথে বাধা সৃষ্টি করে । মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল তরুণ মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের জাতীয় কংগ্রেসে যােগদান থেকে বিরত রাখা । এতে সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট হওয়ায় জাতীয় আন্দোলনগুলি ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
পৃথক রাজনৈতিক পথ :
মুসলিম লীগের গঠন ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে জাতীয় রাজনীতির মূল ধারা থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এক স্বতন্ত্র পথে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যােগদান করতে উৎসাহিত করে । জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে সকলের প্রতিনিধিত্বের দাবিকে লিগ নস্যাৎ করে দেয় । মুসলিম লীগের বিভিন্ন কার্যকলাপে সম্প্রদায়িক ভেদনীতির সৃষ্টি হলে ব্রিটিশ সেই সুযোগের সদব্যবহার করে জাতীয় আন্দোলনকে সহজেই অবদমিত করে রাখে । যেমন — বঙ্গভঙ্গ – বিরােধী আন্দোলনে লিগের পরোক্ষ নির্দেশে মুসলমান সম্প্রদায় প্রচ্ছন্নভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করায় আখেরে সুবিধা হয় ব্রিটিশের ।
বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্ত্বের উদ্ভব :
লীগ প্রমাণ করতে চায় যে , ভারতবাসীকে একটি জাতিতে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয় । হিন্দু ও মুসলমান দুটি পৃথক সত্তা , যাদের মধ্যে ঐক্যের কোনাে সম্ভাবনাই নেই । এই তত্ত্ব ভারতীয় রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদের হাত শক্ত করে , যার পরিণতি মােটেই সুখকর হয়নি । লীগের প্রচ্ছন্ন মদতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসারের জন্য মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ইস্তেহার বিলি করা হয় । এইসব ইস্তেহারগুলিতে তীক্ষ্ণ ভাষায় হিন্দুত্ববাদের বিরােধিতা করায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ে।
অভিজাত মুসলিমদের প্রাধান্য :
মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানরা মূল উদ্যোগ নিলেও বাংলার সঙ্গে এই লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না । বােম্বাই প্রেসিডেন্সির শিক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় ও মুসলিম লীগের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । লীগে মূলত উত্তর ভারতের অভিজাত মুসলিমদেরই প্রাধান্য বজায় ছিল ।
জমিদার শ্রেণির স্বার্থরক্ষা :
মুসলিম জমিদার ও জোতদার শ্রেণির সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষায় লিগ যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়। লীগের লক্ষ্য বা কার্যপদ্ধতিতে ভারতের সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেনি।
মন্তব্য
আলিগড় আন্দোলনের উত্তরসূরিরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বুকে যেভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ব্রিটিশের প্রতি চরম আনুগত্যের প্রবণতা দেখিয়ে আসছিল , মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা তার চরম প্রকাশ ঘটে । পার্সিভাল গ্রিফিথসের মতে—মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার অন্য প্রভাব যাই থাকুক না কেন মুসলমানদের স্বার্থ হিন্দুদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এই বিশ্বাস স্বীকৃতি পেয়েছিল।
উপসংহার
মুসলিম লীগ ভারতে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম দেয় তা ঐক্যবদ্ধ ভারতকে চিরদিনের মতাে দ্বিখণ্ডিত করে দেয় । মুসলিম লীগ ঘােষণা করেছিল ভারতে হিন্দু – মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক মিত্ৰতা সম্ভব , কিন্তু রাজনৈতিক মিত্ৰতা কখনােই সম্ভব নয় । মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরে এ. বি. রাজপুত বলেন — এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দেয় যে , ভারত আর একটি জাতি নয় , তাকে আর তা করাও যাবে না ।