প্রাচ্য সমস্যা বা পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বলতে কি বোঝো
Contents
প্রাচ্য সমস্যা বা পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বলতে কি বোঝো
উনিশ শতকে ইউরােপের বিভিন্ন রাষ্ট্র , বিশেষত রাশিয়া , তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে সেখানে রাজ্যবিস্তারের উদ্যোগ নেয় । এর পাশাপাশি তুরস্কের হাত থেকে বলকান জাতিগােষ্ঠী ও অধীনস্থ সামন্তরা মুক্তির চেষ্টা চালায় । অপরদিকে রাশিয়ার এই আগ্রাসন ইউরােপীয় স্বার্থের প্রতিকূল ভেবে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া তুরস্ক সাম্রাজ্যের সংহতিরক্ষায় এগিয়ে আসে । এর ফলে দক্ষিণ – পূর্ব ইউরােপে এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় , যা পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বা প্রাচ্য সমস্যা নামে পরিচিত । লর্ড মর্লের মতে — বিভিন্ন জাতি , ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে পরস্পরবিরােধী সংঘাতের ফলে যে পরিবর্তনশীল জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয় তাকে প্রাচ্য সমস্যা বলে (‘ Shifting intractable and interwoven tangle of conflicting interests rival people and antagonistic faith ’)।

প্রাচ্য সমস্যা এর পটভূমি
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশ কিছু ঘটনা পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যার পটভূমি রচনা করে —
তুরস্কের দুর্বলতা :
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুর্কি শাসকরা সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ না করায় তুরস্ক সবদিক থেকেই পিছিয়ে পড়ে । আধুনিক যুগের দাবিকে মেনে নিয়ে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী না করায় প্রতিবেশী ইউরােপীয় দেশগুলির আক্রমণ রােধ করার কোনাে ক্ষমতাই ছিল না এই রাষ্ট্রটির । তাই তুরস্ককে তাচ্ছিল্যের সুরে ইউরােপের ‘ রুগণ মানুষ ’ ( The sick man of Europe ) বলা হত ।
বলকান জাতীয়তাবাদ :
তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত বলকান অঞ্চলে সার্ব , গ্রিক , বুলগেরীয় , আলবেনীয় , রুমানীয় , মিশরীয়সহ বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর মানুষ বাস করত । তুর্কি শাসকরা এদের ওপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালাত । এইসব জাতিগােষ্ঠীর মানুষ ফরাসি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় । একে বলকান জাতীয়তাবাদ বলে অভিহিত করা হত এবং তা পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যাকে আরও জটিল করে তােলে ।
রাশিয়ার অগ্রসর নীতি :
রাশিয়া তুরস্কের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে কৃষ্ণসাগরের ওপর দিয়ে দার্দানেলিস প্রণালী অতিক্রম করে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছােবার সুযােগ পায় । এভাবে রাশিয়া বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় ।
ইংল্যান্ড , অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের বিরােধিতা :
বলকান অঞ্চলে রুশ প্রভাব গড়ে উঠছে দেখে ইংল্যান্ড , অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স বিরােধিতা শুরু করে । কেননা ইংল্যান্ডের ভয় ছিল ভূমধ্যসাগরে রুশ অগ্রগতির প্রসার ঘটলে ইংল্যান্ডের নৌ – আধিপত্যের ব্যাঘাত ঘটবে । ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া নিজেদের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক সুবিধার স্বার্থে রুশ আগ্রাসনের বিরােধিতা করলে পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বা প্রাচ্য সমস্যা জটিল হয়ে ওঠে ।
প্রাচ্য সমস্যা এর স্বরূপ
ইউরােপের পূর্বদিকে অবস্থিত অঞ্চল বলকান অঞ্চল নামে পরিচিত । এই অঞ্চলটির দক্ষিণ – পূর্বে রয়েছে দানিয়ুব উপত্যকা , পূর্বে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর , পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর ও ইজিয়ান সাগর , উত্তরে হাঙ্গেরি ও দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর । এই বলকান অঞ্চলটির মধ্যেকার রুমানিয়া , বুলগেরিয়া , সার্বিয়া , মলদাভিয়া , আলবেনিয়া , গ্রিস প্রভৃতি অঞ্চলগুলি প্রাচ্য দেশের খুব কাছাকাছি থাকায়পূর্বাঞ্চল সমস্যা বা প্রাচ্য সমস্যা নামেও পরিচিত । পঞ্চদশ , ষােড়শ ও সপ্তদশ শতক জুড়ে এশিয়া , আফ্রিকা ও ইউরােপের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তুরস্ক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল । মালােইজের সন্ধির ( ১৬৯৯ খ্রি. ) পর থেকেই তুর্কি সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি ঘটতে শুরু করে । এর ফলেই পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা বা প্রাচ্য সমস্যা সৃষ্টি হয় । এ প্রসঙ্গে ড. মিলার বলেছেন — ইউরােপে তুর্কি সাম্রাজ্যের ক্রমবিলুপ্তিকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা-ই পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যা ।