ইতিহাস

তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতি আলোচনা কর

Contents

তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতি আলোচনা কর

ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়ন তাঁর পররাষ্ট্র অর্থাৎ বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে কোনাে একটা স্থির কর্মপন্থা কখনও অনুসরণ করে যেতে পারেননি । তবে সিংহাসনে বসেই তিনি ঘােষণা করেন যে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে শান্তিনীতি মেনে চলবেন । রাজত্বের প্রথম আট বছর সাফল্য লাভ করে তৃতীয় নেপােলিয়ন পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ফ্রান্সের গৌরব যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছিলেন । কিন্তু তারপর থেকে তিনি দারুণভাবে ব্যর্থ হন ।

Napoleon III. of France 1
তৃতীয় নেপােলিয়ন

তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতির সাফল্য

দেশ ও নিজের মর্যাদা বৃদ্ধিতে :

কাকা নেপােলিয়ন বােনাপার্টের মস্কো অভিযানে ব্যর্থতার জ্বালা জুড়ােতে তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ( ১৮৫৪-৫৬ খ্রি. ) তুরস্কের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যােগ দেন । যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের পর ফরাসিবাসীর কাছে যেমন তিনি নায়কে পরিণত হন , আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমনি ফ্রান্সের সুনাম ও গৌরব বৃদ্ধি করার পাশাপাশি নিজের মর্যাদাও বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন।

পােপের কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় :

ইতিপূর্বে তৃতীয় নেপােলিয়ন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে রোম অভিযান করে সেখানে ম্যাৎসিনি প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পােপের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং ক্যাথােলিকদের কৃতজ্ঞতাভাজন হন ।

স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় :

তাঁর সমর্থনের ফলেই মােলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়ার স্বায়ত্তশাসন লাভ সম্ভব হয় ।

ইতালির ঐক্যসাধনে :

এরপর ভিয়েনা ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়ে তিনি ইতালির ঐক্য আন্দোলনে এক অসামান্য ভূমিকা গ্রহণ করেন ।

  1. ক্যাভুরের সঙ্গে প্লোমবিয়ার্স – এর গােপন চুক্তি ( ১৮৫৮ খ্রি. ) দ্বারা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে সার্ডিনিয়াকে সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতি দেন , যার ফলে ফ্রাঙ্কো – সার্ডিনীয় সৈন্যদলের হাতে মেজেন্টা ও সলফেরিনাের যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরাজয় ঘটে ;
  2.  সার্ডিনিয়া – পিডমন্টকে কেন্দ্র করে উত্তর ইতালীয় রাজ্য সৃষ্টি হয় ; 
  3. ফ্রান্স স্যাভয় ও নিস লাভ করে । এইসব কর্মসূচি পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে তৃতীয় নেপােলিয়নের সাফল্যকে চরম অবস্থায় পৌছে দেয় ।

তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা 

১৮৫২ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তৃতীয় নেপােলিয়ন শাসক হিসেবে মােটামুটি সাফল্য দেখান । কিন্তু অস্থিরচিত্ততা শেষপর্যন্ত তাঁকে ক্রমব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয় । ১৮৬০ – এর পর থেকেই তৃতীয় নেপােলিয়নের চিন্তার স্ববিরােধিতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়তে থাকে । প্লোমবিয়ার্স – এর চুক্তিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ক্যাভুরের অজ্ঞাতেই নেপােলিয়ন অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি ( ১৮৫৯ খ্রি. ) করে যুদ্ধ থেকে সরে গিয়ে তাঁর ভ্রান্ত বিদেশনীতির পরিচয় দেন ।

ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি স্বাক্ষরের পর থেকেই শুরু হয় তৃতীয় নেপােলিয়নের একটির পর একটি ব্যর্থ বৈদেশিক অভিযান —

পােল্যান্ড ও রাশিয়ার সঙ্গে তিক্ততা :

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পােল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেপােলিয়ন পােল বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে মৌখিক সহানুভূতি জ্ঞাপন করলে জার তীব্র প্রতিবাদ জানান । এরপর তিনি পােলদের সাহায্য করা থেকে বিরত হলেও রাশিয়ার সঙ্গে তার তিক্ততা কমেনি ।

মেক্সিকো অভিযান :

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সুযােগে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় নেপােলিয়ন অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রান্সিস জোসেফের ভাই ম্যাক্সিমিলিয়ানকে নিজ মনােনীত প্রার্থী হিসেবে মেক্সিকোর সম্রাট বলে ঘােষণা করেন । কিন্তু গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ম্যাক্সিমিলিয়ান মেক্সিকোবাসীর হাতে প্রাণ হারান । ফলে নেপােলিয়নের মেক্সিকো অভিযান ব্যর্থ হয় । ফ্রান্সের প্রচুর অর্থ ও লােকক্ষয় হয় । নেপােলিয়ন অপদস্থ হন । তাঁর ও ফ্রান্সের মর্যাদায় বিরাট আঘাত আসে । নেপােলিয়ন পতনের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান ।

স্যাডােয়ার যুদ্ধে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত :

এরপর অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মধ্যে স্যাডােয়ার যুদ্ধে ( ১৮৬৬ খ্রি. ) নেপােলিয়ন নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনেন । এই যুদ্ধে প্রাশিয়ার জয়ের অর্থই ছিল নেপােলিয়নের কূটনীতির চরম পরাজয় । তাই বলা হয় , স্যাডােয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া নয় , ফ্রান্সই পরাজিত হয়েছিল । তার ওপর স্যাডােয়ার যুদ্ধে নিরপেক্ষতার পুরস্কার হিসেবে নেপােলিয়নের জার্মান সীমান্তে ভূখণ্ডের দাবি প্রাশিয়া কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় । ফলে নেপােলিয়নের কূটনীতির অসারতা প্রকাশ পেয়ে যায় ।

সেডানের যুদ্ধে ব্যর্থতা :

বিসমার্ক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন , ফ্রান্সের সঙ্গে প্রাশিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি অনিবার্য ব্যাপার । অথচ এই সহজ সত্যটি নেপােলিয়নের দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েনি । তাঁর এই দূরদৃষ্টিহীনতার অনিবার্য পরিণতিই ছিল সেডানের যুদ্ধ ( ১৮৭০ খ্রি. ) । যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রাশিয়ার হাতে সম্রাট তৃতীয় নেপােলিয়ন বন্দি হন । এরই সঙ্গে তৃতীয় নেপােলিয়ন ও ফ্রান্সের দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ।

তৃতীয় নেপোলিয়নের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতার কারণ

তৃতীয় নেপােলিয়নের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার জন্য তিনটি সুস্পষ্ট কারণ দায়ী ছিল—

স্ববিরােধী চিন্তা :

তৃতীয় নেপােলিয়নের চিন্তার স্ববিরােধিতা ও চরিত্রের পরস্পরবিরােধী বৈশিষ্ট্য তাঁর পতন ডেকে আনে ;

মৌলিক প্রতিভার অভাব :

তিনি তাঁর কাকা নেপােলিয়ন বােনাপার্টের আলােয় আলােকিত হতে চেয়েছিলেন , কিন্তু নিজের মৌলিক প্রতিভার একান্তই অভাব ছিল ;

রাজনৈতিক দক্ষতার অভাব :

রাজনীতিক হিসেবে তিনি বিসমার্কের কাছে নিতান্তই নিষ্প্রভ ছিলেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!