দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

Khilji Dynasty
সুলতানি সাম্রাজ্য

মহম্মদ ঘুরি দিল্লি দখল করে ভারতে তুর্কি শাসনের সূচনা করেন । কুতুবউদ্দিন আইবক স্বাধীন দিল্লি সুলতানির সূচনা করেন ( ১২০৬ খ্রি. ) । তিনশাে বছর অবস্থানের পর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ( ১৫২৬ খ্রি. ) মােগল বীর বাবরের হাতে ইব্রাহিম লােদির পরাজয়ের সঙ্গে সুলতানি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে । দিল্লি সুলতানির পতনের জন্য একাধিক কারণ দায়ী ছিল ।

সাম্রাজ্যের বিশালতা

সুলতান আলাউদ্দিন খলজি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুলতানি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করেন । এত বিশাল সাম্রাজ্যের সুরক্ষার জন্য দক্ষ শাসন ও উন্নত শাসনকাঠামাে আবশ্যিক ছিল । কিন্তু সুলতানি সাম্রাজ্যের অধিকাংশ সুলতান ছিলেন অদক্ষ এবং উন্নত শাসনকাঠামাে তাঁরা গড়তে পারেননি ।

জনসমর্থনের অভাব

সুলতানি সাম্রাজ্য নিছক সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল । এই রাজ্য সম্পর্কে প্রজাসাধারণের কোনাে অনুরাগ বা আসক্তি ছিল না । শাসক ও শাসিতের দুস্তর ব্যবধান সাম্রাজ্যের ভিত বরাবরই দুর্বল করে রেখেছিল ।

অভিজাতদের সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা

সুলতানি প্রশাসনের মূল ভিত্তি ছিল অভিজাতশ্রেণি । অভিজাতরাই সামরিক ও অসামরিক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন । রাজ্যের সকল সুখ – সুবিধা ও মর্যাদা তাঁরা ভােগ করতেন । কিন্তু সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি বা স্থায়িত্বের প্রতি তাঁদের কোনাে নজর ছিল না । উপরন্তু নানা অজুহাতে সুলতানকে বিব্রত করে অধিকতর ক্ষমতা দখল করতে তাঁরা সদা তৎপর ছিলেন । এজন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতেও তাঁরা দ্বিধা করতেন না । ফলে রাজশক্তি কখনই কেন্দ্রীভূত ও আত্মনির্ভর হতে পারেনি ।

যােগ্য নেতৃত্বের অভাব

সুলতানি সাম্রাজ্যে ধারাবাহিকভাবে যােগ্য শাসকের আবির্ভাব ঘটেনি । ইলতুৎমিস , বলবন , আলাউদ্দিন প্রমুখ সাম্রাজ্যের ভিত সুদৃঢ় করতে চেষ্টা করেন । কিন্তু অন্যান্য সুলতানদের কার্যধারা সাম্রাজ্যের ভিত দুর্বল করে পতন ত্বরান্বিত করে । সৈয়দ ও লােদীবংশের আমলে প্রশাসনের দক্ষতা প্রায় নিঃশেষ হয়ে পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে ।

হিন্দুদের আনুগত্যের অভাব

তুর্ক – আফগান শাসকরা হিন্দুদের আনুগত্য লাভের আন্তরিক চেষ্টা করেননি । তাঁরা আক্ষরিক অর্থে ধর্মান্ধ বা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না । কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে হিন্দু সম্প্রদায়কে প্রশাসনের অঙ্গে পরিণত করার উদ্যোগ তাঁরা নেননি । আবার কোনাে কোনাে শাসক যেমন— ফিরােজ শাহ তুঘলক , সিকন্দর লােদী প্রমুখের হিন্দু – পীড়ন নীতি সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাঙন ডেকে আনে । তাঁরা হিন্দু রাজশক্তির উত্থানে পরােক্ষভাবে ইন্ধন জোগান । উত্তর ভারতে রাজপুত রাজ্য এবং দক্ষিণে বিজয়নগর রাজ্যের উত্থানে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চেতনা সক্রিয় ছিল ।

প্রশাসনের ওপর ধর্মের প্রভাব

সুলতানি শাসন ধর্মাশ্রয়ী ছিল না । কিন্তু তাঁরা আদর্শগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন , এ কথা বলা যায় না । আলাউদ্দিন , মহম্মদ তুঘলককে বাদ দিলে অন্যান্যদের আমলে প্রশাসনের ওপর উলেমাদের যথেষ্ট দাপট ছিল । স্বভাবতই অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রজা সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না । জিজিয়া কর , হিন্দুদের ওপর অধিক কর আরােপ ইত্যাদি ঘটনা অ – মুসলমান প্রজাদের ক্ষুদ্ধ করেছিল ।

সামন্ততান্ত্রিকতার প্রকোপ

জায়গিরদারী প্রথা , ইকতাদারী ব্যবস্থা পরিণামে সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতার জন্ম দিয়েছিল । এইসব আঞ্চলিক শাসক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন । তাঁদের বিচ্ছিন্নতাবােধ কার্যত কেন্দ্রীকরণ প্রবণতার বিরােধী ছিল । ফলে শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা অনিশ্চিত হয়ে সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয় ।

বৈদেশিক আক্রমণ

অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযােগে বিদেশি শক্তির আক্রমণ সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে । মােঙ্গল উপজাতির ঘনঘন আক্রমণে রাজ্যের শক্তি ও অর্থ অপচয় হত । শেষ মুহূর্তে তৈমুর লঙের আক্রমণ , ধ্বংসকার্য ও লুণ্ঠন সুলতানির প্রাণবায়ু নিঃশেষ করে । তাই বাবর খুব সহজেই দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে সক্ষম হন । 

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!