ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ গুলি আলোচনা করো

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ গুলি আলোচনা করো

রাজা চতুর্দশ লুই – এর আমল থেকে ফ্রান্সের বুকে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় তা ১৭৮৯ খ্রি. ফরাসি বিপ্লবের জন্য অনেকটাই দায়ী ছিল বলা চলে । মূলত অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক থেকে ফ্রান্সের রাজকোশ অর্থশূন্য হয়ে পড়ে । বিভিন্ন প্রকার ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা , রাজপরিবারের বিলাসব্যসন , মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি ফ্রান্সে আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনে । ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ  ফ্রান্সের এই সময়কার অর্থনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন — ফ্রান্স ছিল ভ্রান্ত অর্থনীতির এক বিশাল জাদুঘর (‘ France was a vast museum of economic errors ’) । ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণ ছিল —

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ
ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ

কর আরােপে বৈষম্য

বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সে সকল নাগরিকের ওপর সমানভাবে কর বণ্টিত হয়নি । ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণিভুক্ত ধর্মযাজক এবং দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত অভিজাতরা জমির সব থেকে বেশিরভাগ অংশ ভােগ করলেও তাদের  কর প্রদানের হাত থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছিল । ফ্রান্সে তৃতীয় সম্প্রদায়কে শতকরা ৯৬ ভাগ রাজস্ব দিতে হত , আর বাকি ৪ ভাগ রাজস্ব দিতে হত প্রথম ও দ্বিতীয় সম্প্রদায়কে । সমস্ত কর দেওয়ার পর তৃতীয় সম্প্রদায়ের হাতে থাকত মােট আয়ের এক – পঞ্চমাংশ , যা দিয়ে তাদের পক্ষে জীবনধারণ করা অসম্ভব ছিল । কার্লাইল – এর মতে — এক-তৃতীয়াংশ কৃষক বছরের তিন ভাগের একভাগ সময় শুধুমাত্র আলু খেয়ে জীবনধারণ করত । তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই বিশাল করের বােঝা থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ।

কর আদায়ে নিপীড়ন ও নির্যাতন

ফরাসিবাসীর ওপর বিভিন্ন করের বােঝা চাপানাে হয়েছিল , যেগুলি ছিল ত্রুটিপূর্ণ । যেমন — ক্যাপিটেশন ( আয় কর ) , তেইলি ( সম্পত্তি কর ) , গ্যাবেলা ( লবণ কর ) , ভিটিংয়েমে ( জমি ও ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর কর ) , টাইদ ( চার্চকে প্রদত্ত ধর্ম কর ) , এডস ( মদ , তামাকের ওপর কর ) , করভি ( শ্রম কর ) । এ ছাড়াও সামন্তপ্রভুকে দিতে হত পেয়াজ ( পথ , সেতু ও খেয়াঘাটের ওপর ধার্য কর ) , বানালিতে ( উৎপাদিত ফসলের এক নিদিষ্ট অংশ প্রদানের বিনিময়ে সামন্তপ্রভুর কলে গম , যব ভাঙানাে বা মদ তৈরির বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা ) , শঁস ( সাধারণ মুদ্রায় প্রদেয় বার্ষিক খাজনা ) , শঁপার ( উৎপাদিত ফসলে প্রদত্ত কর ) ইত্যাদি । ফারমিয়ের‌ জেনারেল নামে কনট্রাক্টরের মাধ্যমে এইসব কর ফরাসিবাসীর কাছ থেকে জোরজবরদস্তি আদায় করা হতো। এককালীন কিছু অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত ব্যাক্তিদের কর সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হতো। তারা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কর সংগ্রহের নামে নিপীড়ন ও নির্যাতন চালাত, এতে ফরাসি বাসী ক্ষুব্ধ হয়।

রাজপরিবারের বিলাসব্যসন

চতুর্দশ লুই- এর আমল থেকেই ফরাসি রাজপরিবারের বিলাসব্যসন  রূপকথায় পরিণত হয় ।  রমণীরঞ্জন প্রজাপতি রাজা পঞ্চদশ লুই বিলাসিতায় ডুবে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে অর্থ নষ্ট করেন। ঐতিহাসিক গুডউইন এর লেখা থেকে জানা যায় — রাজা ষােড়শ লুইয়ের স্ত্রী তথা অস্ট্রিয়া রাজকন্যা মেরি আঁতোয়ানেতের ভৃত্যের সংখ্যা ছিল ৫০০ । আর ভার্সাই রাজপ্রাসাদে কাজের জন্য নিয়ােজিত ছিল ১৬ হাজার কর্মচারী। রাষ্ট্রীয় আয়ের শতকরা ১২ ভাগ রাজপ্রাসাদের বিলাসিতায় এবং শতকরা ১২ ভাগ সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ খরচ হত । রাজপরিবারের সদস্যরা নিত্যনতুন পােশাক পরিধান করতেন এবং ভােজসভায় প্রচুর খাদ্য নষ্ট করে অর্থের অপচয় ঘটাতেন । পঞ্চদশ লুইয়ের স্ত্রী মাদাম পম্পাদ্যু মণিমুক্তার পিছনে রাজকোশের প্রচুর অর্থ খরচ করেন।আসলে রাজকৰ্তব্য ভুলে বিলাসিতায় মত্ত হয়ে থাকা রাজাদের অপদার্থতাই অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয় । যার ফলে রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে প্রজাদের মনে বিরূপ ধারণা জন্মায় । রাজপরিবারের‌ বিলাসিতা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক গুডউইন তাঁর ‘ French Revolution ’ গ্রন্থে লিখেছেন বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কথা ছিল বিশাল খরচের বােঝা কমানাের অসম্ভাব্যতা ।

ভ্রান্ত যুদ্ধনীতি

চতুর্দশ লুই স্পেনের উত্তরাধিকার যুদ্ধে ( ১৭০২ – ১৭১৩ খ্রি. ) ফ্রান্সকে যুক্ত করেন । অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে ( ১৭৪০ – ১৭৪৮ খ্রি. ) পঞ্চদশ লুইয়ের ফ্রান্স অংশগ্রহণ করে ঋণের জালে জড়িয়ে যায়, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ( ১৭৫৬ – ১৭৬৩ খ্রি. ) যােগদান করেও ফ্রান্সের প্রচুর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয় । ষােড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে উপনিবেশবাসীদের অর্থ সাহায্য করলে ফ্রান্স দেউলিয়া হয়ে পড়ে । তাই কোব্যান  বলেছিলেন — আমেরিকার স্বাধীনতার মূল্য হল ফরাসি বিপ্লব । এসময়ে ফ্রান্সের মােট আয়ের শতকরা ৭৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ও সুদ বাবদ সরকারকে খরচ করতে হত । যুদ্ধ ব্যয় সম্পর্কে রাজা ষােড়শ লুই – এর অর্থমন্ত্রী টুর্গো  বলেছিলেন — আর-একটি কামান দাগা হলেই রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে ।

মুদ্রাস্ফীতি

ফ্রান্সের অর্থনীতিকে শােচনীয় করার ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতিরও ভূমিকা ছিল । উত্তরােত্তর মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধির জন্যই নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র ও খাদ্যশস্যের দাম অত্যন্ত বেড়ে যায় । জিনিসপত্রের দাম শতকরা ৬৫ ভাগ বাড়লেও সেই অনুপাতে শ্রমিক বা মজুরদের বেতন বা মজুরি বাড়েনি । ফরাসি বিপ্লবের সূচনার এক যুগ আগে থেকেই প্যারিস , লায়নস প্রভৃতি শহরে রুটির জন্য দাঙ্গা বেধেছিল । ষােড়শ লুই ফরাসিবাসী খাদ্য সমস্যা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় বহু মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে । আসলে রাজস্ব মূল্যমানের ওঠানামা ১৮ শতকের ফ্রান্সে অর্থনীতির একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল । এই মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত হয়ে ফরাসিবাসী বিপ্লবের রাস্তায় যায় ।

অনুন্নত কৃষি অর্থনীতি

ফ্রান্সে কৃষি ছিল অর্থনীতির মূল ভিত্তি । মােট আড়াই কোটি ফরাসিবাসীর মধ্যে দু- কোটি বিশ লক্ষ অর্থাৎ শতা ৮০ ভাগ লােক কৃষক হলেও কৃষিব্যবস্থা ছিল অনুন্নত । অনাবাদি জমিতে কৃষিকাজ , সরকারি তরফে সাহায্যের অভাব , যন্ত্রপাতিসহ আধুনিক কৃষিজ উপকরণের অভাব , সর্বোপরি কৃষকদের রক্ষণশীল মনােভাব ইত্যাদি কারণে ফ্রান্সের কৃষি ব্যবস্থা উন্নত হতে পারেনি । বিপ্লবের পূর্ববর্তী দশ বছর ( ১৭৭৮-১৭৮৮ খ্রি. ) ধরে একটানা কৃষিক্ষেত্রে সংকট চলে । তার ওপর বিপ্লবের পূর্ববর্তী তিন বছর ( ১৭৮৬-১৭৮৮ খ্রি. ) ধরে কখনাে অতিবৃষ্টি , কখনাে বা অনাবৃষ্টি এবং খরা , শস্যহানি ইত্যাদির জন্য কৃষিজ ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় । এইরকম কৃষিজ কাঠামােয় অষ্টাদশ শতকের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়লে কৃষকদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে । তাই ঐতিহাসিক সি. ই. লাব্রুজ  বলেছেন — অষ্টাদশ শতাব্দীতে মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ।

উপসংহার

মূলত ১৭৩০ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ফ্রান্সের যে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল , পরবর্তী দশ বছরের মধ্যেই তা অবক্ষয়ের পথে চলে যায় । আর্থিক শােষণে জর্জরিত ফরাসিবাসী সহজ সরল স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য বিপ্লবের রাস্তায় গিয়েছিল । অবশেষে রাজা ষােড়শ লুই রাষ্ট্রের তীব্র অর্থসংকট মেটানাের লক্ষে স্টেটস্ জেনারেল বা জাতীয় মহাসভার অধিবেশন ডাকলে ( ১৭৮৯ খ্রি. ৫ মে ) বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । ফরাসি বিপ্লবের জন্য অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করে ঐতিহাসিক রাইকার  বলেছেন — বিপ্লবের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক (‘ The fiscal causes lay at the root of the Revolution ’)।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!