ইতিহাস

ফরাসি বিপ্লবে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব

Contents

ফরাসি বিপ্লবে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্ব

ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন ফ্রান্সের শাসকশ্রেণি বুরবোঁ রাজতন্ত্র সবথেকে বেশি দায়ী ছিল । ফ্রান্সের সবচেয়ে শক্তিশালী বুরবোঁ রাজা চতুর্দশ লুই – এর আমল ( ১৬৪৩ – ১৭১৫ খ্রি. ) থেকে ফ্রান্সে যে স্বৈরাচার শুরু হয় তার ফলেই ফরাসিবাসী বিপ্লবের রাস্তায় যেতে বাধ্য হয় । আসলে যুগের প্রয়ােজনে নিজেদেরকে পরিবর্তিত না করায় ইতিহাস ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্রকে দায়ী করেছে । ঐতিহাসিক মাদেলা  ফরাসি বিপ্লবের জন্য বুরবোঁ রাজতন্ত্রকে দায়ী করে বলেছেন — ফরাসি রাজতন্ত্রই বিপ্লব ঘটিয়েছে ( ‘ The French monarchy, which made the Revolution ’ ) । বুরবোঁ রাজতন্ত্রের দায়িত্বগুলি ছিল —

forasi biplob1
রাজা চতুর্দশ লুই

স্বৈরাচারী রাজাদর্শ

ফরাসি-রাজ চতুর্দশ লুই নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করেন । নিজেদের ক্ষমতাকে ঈশ্বর প্রদত্ত রূপ দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন । চতুর্দশ লুই বলেন — আমিই রাষ্ট্র ( I am the state ) । ষােড়শ লুই বলেন — আমার ইচ্ছাই আইন ( ‘ What I desire is decree ’ ) । ফরাসি জাতিও রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল । কিন্তু এই স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক আদর্শ জনগণের কাছে  বিভীষিকা ও আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না । লা মার্টিনের  মতে — ফরাসি জাতির কাছে রাজা ঈশ্বর , তাঁকে মেনে চলাই ধর্ম ।

রাজন্যবর্গের দূর্বলতা

ফরাসি রাজারা অধিকার প্রয়ােগের ব্যাপারে যতটা সজাগ ছিলেন কর্তব্য পালনের ব্যাপারে ঠিক ততটাই উদাসীন ছিলেন । অষ্টাদশ শতকে অকর্মণ্য রাজা পঞ্চদশ লুই , অপদার্থ রাজপ্রতিনিধি ডিউক অব অর্লিয়েন্স , দুর্বলচেতা ষােড়শ লুই প্রমুখের মিলিত প্রচেষ্টায় ফ্রান্স এক দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের রূপ নেয় । অর্থনীতি , রাজনীতি , সমাজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রকে ফরাসি রাজতন্ত্র সংকটের মুখে ঠেলে দেয় । প্রজাপতি রাজারূপে পরিচিত  পঞ্চদশ লুই সম্পূর্ণরূপে তাঁর পত্নী মাদাম দ্য পম্পাদ্যুর মােহে আচ্ছন্ন ছিলেন । তাঁর দুর্বলতার জন্যই যে ফ্রান্স পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা তিনি মৃত্যুর আগে অনুভব করে বলেন — আমার পরেই মহাপ্রলয় আসছে ( “ After me deluge ” ) ।

অভিজাতদের উৎশৃঙ্খলতা এবং অত্যাচার

ফরাসি রাজাদের চারিত্রিক দুর্বলতা , নৈতিক অবক্ষয় ও অকর্মণ্যতার সুযােগ নিয়ে অভিজাতরা শাসনকাজ পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে । ইনটেনডেন্ট নামক কর্মচারীরা শাসনব্যবস্থাতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে । ফরাসি অভিজাতরা এমন দাবিও করে যে , তারা রাজার  সমশ্রেণিভুক্ত । অভিজাতরা তাদের ব্যক্তিগত শুভানুধ্যায়ীদের মুক্ত করার জন্য লেতর দ্য গ্রাস ( Lettre de Grace ) এবং শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য রাজাকে দিয়ে লেতর দ্য ক্যাশে ( রাজকীয় পরােয়ানা ) – তে সই করিয়ে নেয় । ফরাসি রাজারাও শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজাতদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল ছিলেন যে অভিজাতদের প্রভাব – প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা হ্রাস করতে তাঁরা ব্যর্থ হন । অভিজাতদের উৎশৃংঙ্খলতা ও অত্যাচারে সাধারণ ফরাসিবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । হ্যাম্পসনের  মতে — শাসনব্যবস্থাতে অভিজাতদের প্রভাব অবাঞ্চিত পরিস্থিতি তৈরি করে ( ‘ The aristocratic infiltration produced unsavoury results ’ ) ।

দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারব্যবস্থা 

ফরাসি বিচারব্যবস্থা ছিল দুর্নীতিতে ভরা । বিচারের নামে সেখানে প্রহসন চলত । দোষী সাব্যস্তদের বাস্তিল দুর্গে আটকে রাখা হত । বিচারকের পদ সরকারের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে কেনা  যেত । বিচারকদের সরকার বেতন দিত না । তারা জরিমানা থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরােটাই ভােগ করত । বিচারকের পদ ছিল বংশানুক্রমিক । রাজা লেতর দ্য গ্রাস এবং লেতর দ্য ক্যাশে ক্ষমতার প্রয়ােগ করে অপরাধীদের শাস্তির মেয়াদ হ্রাস বা মুক্তি দেওয়া এবং যে – কোনাে নাগরিককে বন্দি করে বিনা বিচারে কারাগারে আটকে রাখতে পারতেন । যাজকরা নিজেদের আইন নিজেরাই তৈরি করতেন এবং অভিজাতদের জন্যও নিজস্ব আইন ছিল । আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল না । অপরাধীদের শাস্তি অপরাধের গুরুত্ব অনুপাতে অনেক  বেশি কঠোর ছিল ।

রাজপরিবারের বিলাসিতা 

ফরাসি-রাজ চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকাল থেকেই ভার্সাই রাজপ্রাসাদ হয়ে ওঠে ঐশ্বর্যের ইন্দ্রপুরী । রাজপরিবারের বিলাসব্যসন ও অমিতব্যয়িতা ছিল অকল্পনীয় । রানি মেরি আঁতােয়ানেত ভার্সাইয়ের টুইলারিশ প্রাসাদের কাচের ঘরে বাস করতেন । রাজপরিবারের সদস্যরা নিত্যনতুন পােশাক ব্যবহার  করতেন । ভােজসভাতে প্রয়ােজনের বেশি অর্থ খরচ করা হত । ঐতিহাসিক গুডউইন – এর মতে — ভার্সাই রাজসভার ১৮ হাজার কর্মচারীর মধ্যে ১৬ হাজার জনই রাজপ্রাসাদের কাজ করত । এর মধ্যে রানির ভৃত্যের সংখ্যা ছিল ৫০০ জন । একদিকে যখন রাজপরিবারের এই বিলাসিতা চলছে অপরদিকে তখন সাধারণ ফরাসিবাসী জীবনধারণের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে । জীবনযাপনের এই বৈষম্য ফরাসিবাসীকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তােলে ।

ফরাসি বিদেশনীতির ব্যর্থতা

ফরাসি রাজতন্ত্রের ব্যর্থ বিদেশনীতি বা পররাষ্ট্রনীতিও ফরাসি বিপ্লবের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল । পঞ্চদশ লুই অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকারের যুদ্ধে ( ১৭৫৫ – ৬৩ খ্রি. ) এবং সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ( ১৭৫৬ – ১৭৬৩ খ্রি. ) হেরে গেলে আমেরিকা ও ভারতের ফরাসি উপনিবেশগুলি হাতছাড়া হয় । এর পরেও ষােড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ফ্রান্সকে জড়িয়ে দিয়ে ফ্রান্সের অর্থনীতিকে শােচনীয় করে তােলেন । বিদেশনীতির এই ক্রমাগত ব্যর্থতা ফরাসিবাসীর কাছে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে ।

রাজস্বনীতির কুফল

বুরবোঁ রাজতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট কোনাে রাজস্বনীতি ছিল না বা কেনােরকম বাজেট ( বাৎসরিক আয়ব্যয়ের হিসাব ) তৈরিরও ব্যাপার ছিল না । করভার সকল ফরাসিবাসী বা ফ্রান্সের সকল প্রদেশে সমভাবে বণ্টিত হয়নি । অভিজাত ও উচ্চ যাজকদের কর দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও পােয়েসির চুক্তি ( ১৫৬১ খ্রি. ) অনুযায়ী তাদেরকে করদাতার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল । প্রশাসনিক আয়ব্যয়ের মধ্যে ফারাক ছিল যথেষ্ট । সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতির অভাবে রাজতন্ত্র আর্থিক সংকটে পড়েছিল । রাজস্ব ব্যবস্থার বৈষম্য ফরাসিবাসীকে ক্ষুব্ধ করে ।

ষােড়শ লুইয়ের দায়িত্ব 

রাজা ষােড়শ লুই ফরাসি বিপ্লবের জন্য কম দায়ী ছিলেন না , তিনি অর্থ সংকট মেটানাের জন্য তাঁর চারমন্ত্রী টুর্গো , নেকার , ক্যালােন ব্রিঁয়াকে নিয়ােগ করে প্রশাসনে জটিলতা সৃষ্টি করেন । প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও যাজক ও অভিজাতদের বিরােধিতার জন্য তার বেশিরভাগই রূপায়ণ করতে পারেননি।

উপসংহার 

অষ্টাদশ শতকে ফরাসি রাজশক্তির সার্বিক ভূমিকা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে ফরাসি বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী  হয়ে ওঠে । ঐতিহাসিক ফিশারের  মতে — ফরাসিরাজ অভিজাতদের বিশেষ অধিকারগুলি লােপ করতে অসমর্থ হলে বিপ্লব ঘটে ( ‘ The Revolution came because the King failed to solve the question of privilege ’ ) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!