আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ
Contents
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজবংশের ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ হয়ে বহু ইংরেজ আমেরিকা মহাদেশের ১৩টি উপনিবেশে বসতি গড়ে তােলে । উপনিবেশগুলির আদি বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানদের পাশাপাশি ইংরেজ , ফরাসি , ওলন্দাজ , সুইডিশ জাতিভুক্ত উপনিবেশবাসীরা উপনিবেশগুলির গভর্নরের পরিচালনায় শাসনব্যবস্থার অধীনস্থ ছিল । কিন্তু ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের কর্তৃপক্ষ এক ঘােষণার আইন ( Declaratory Act ) জারি করে বলে — এখন থেকে উপনিবেশবাসীদের অধিকার ঠিক করবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট । এ ছাড়াও ঘােষণার আইন অনুযায়ী উপনিবেশবাসীদের ওপর একে একে বিভিন্ন কর চাপানাে হলে উপনিবেশবাসীরা স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘােষণা করে ( ১৭৭৬ খ্রি. ) , যা লর্ড অ্যাকটন ও ম্যাক্স বেলফ – এর মতে আমেরিকার বিপ্লব । আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণগুলি হল —

ধর্মীয় বিদ্বেষ
ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের ধর্মীয় অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে ইংরেজরা মাতৃভূমি ছেড়ে আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে এসেছিল , তাদের মধ্যে অনেকেই পিউরিটান ধর্মাবলম্বী ইংরেজের বংশধর । বংশপরম্পরায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই পিউরিটানদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল । তারা কোনাে মতেই ব্রিটেনের রাজার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে রাজি ছিল না ।
জাতীয়তাবােধের উন্মেষ
কয়েক প্রজন্ম ধরে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পাশাপাশি বসবাস করে একই গির্জায় উপাসনা করে উপনিবেশবাসীদের মধ্যে এক ঐক্যবােধ গড়ে উঠেছিল । তারা অনুভব করেছিল ব্রিটিশদের থেকে তাদের অস্তিত্ব আলাদা । প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকা এবং আমেরিকাতে নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকায় তারা আমেরিকার জাতীয় চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয় । টমাস জেফারসন উপনিবেশবাসীদের জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলেন — স্বাধীনতা বৃক্ষের জন্য গণতন্ত্রের মতাে ওষুধ দরকার ।
দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা
টম পেইন , টমাস জেফারসন , লক , হ্যারিংটন , মিলটন , মন্তেস্কু প্রমুখের দার্শনিক ভাবনা উপনিবেশবাসীর মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলে । এ ছাড়াও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন , জন ওয়াইজ , রজার উইলিয়ামস , জোনাথন মেহিউ প্রমুখ লেখকের লেখনী উপনিবেশবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল । এসময়কার হার্ভার্ড , উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি কলেজ , ইয়েলে কলেজ , পেনসিলভানিয়া , কলম্বিয়া , ডার্টমাউথ প্রভৃতি শিক্ষাকেন্দ্রগুলি এবং নিউজ লেটারসহ পঁচিশটি সংবাদপত্র উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার সপক্ষে মত প্রকাশ করে ।
সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব
সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ( ১৭৫৬ – ৬৩ খ্রি . ) ফ্রান্স হেরে যাওয়ায় উত্তর আমেরিকার ফরাসি উপনিবেশ কানাডা ইংল্যান্ডের দখলে আসে । ফলে উপনিবেশবাসীদের মন থেকে ফরাসি ভীতি দূর হয় । তারা একজোট হয়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে । ঐতিহাসিক এডমন্ড রাইটের মতে — ফরাসি ভীতি দূর হওয়ায় আমেরিকার বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে ।
নেভিগেশন আইন
স্টুয়ার্ট রাজা দ্বিতীয় চার্লসের আমলে পাস করানাে নেভিগেশন আইনে ( ১৬৬০ খ্রি. ) বলা হয় —
- আমেরিকাতে কোনাে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কলকারখানা গড়ে তােলা যাবে না ।
- আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশে উৎপাদিত সামগ্রী , যথা — নীল , চিনি , তুলাে , তামাক ইত্যাদি ইংল্যান্ডের জাহাজের মাধ্যমে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই রপ্তানি করা যাবে ।
- ইংল্যান্ডজাত সমস্ত পণ্য সামগ্রীও ইংল্যান্ডের জাহাজের মাধ্যমে আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশে আসবে ।
- উপনিবেশগুলিতে তুলােজাত কোনাে দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা চলবে না ।‘ বাের্ড অব ট্রেড অ্যান্ড প্ল্যানটেশান ’ নামে এক কর্তৃপক্ষের ওপর উপনিবেশ নিয়ন্ত্রণের ( ১৬৯৬ খ্রি. ) ও নেভিগেশন আইনে আরও কিছু বিশেষ ধারা যােগ করার অধিকার দান করা হয় । মােলাসেস আইন ( Molasses Act , 1733 ) জারি করে ফ্রান্স ও স্পেনের অধীনস্থ পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে উপনিবেশগুলির বাণিজ্য বন্ধের ব্যবস্থা গৃহীত হয় ।
সহায়তার পরোয়ানা
সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রচুর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় জাতীয় ঋণ অত্যধিক বেড়ে যায় । এই আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসনব্যয় উপনিবেশবাসীদের কাছ থেকেই আদায় করার নীতি নেয় ব্রিটিশ । ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লর্ড গ্রেনভিল চোরাচালান বন্ধের জন্য ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়তার পরােয়ানা নামক এক আইন পাস করান ( ১৭৬৩ খ্রি. ) । এই আইনের বলে ইংল্যান্ড বাদে অন্য কোনাে ইউরােপীয় দেশ থেকে সরাসরি কিছু কেনার ওপর উপনিবেশগুলিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় । এ ছাড়াও এই আইনের সাহায্যে কোনােরকম আগাম সতর্ক না করে উপনিবেশবাসীদের বাড়ি তল্লাশি চালানাে হত ।
সুগার অ্যাক্ট বা চিনি আইন ( ১৭৬৪ খ্রি. )
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল সুগার অ্যাক্ট বা চিনি আইন জারি করেন । এতদিন ধরে উপনিবেশবাসীরা সস্তায় ফরাসি উপনিবেশ কানাডা থেকে যে চিনি ও ঝােলা গুড় আমদানি করত , সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধজয়ের ফলে কানাডা ব্রিটিশের দখলে আসায় এই আমদানি দ্রব্যের ওপর করের হার ২.৫ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এর পরোক্ষ প্রভাবে আমেরিকায় মদের দাম বেড়ে যায়, ফলে উপনিবেশবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
স্ট্যাম্প অ্যাক্ট ( ১৭৬৫ খ্রি. )
রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া ও ফরাসিদের থেকে অধিকৃত অঞ্চলগুলি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উত্তর আমেরিকায় দশ হাজার সেনা মােতায়েন করে । এইসব ব্রিটিশ সেনার মােট খরচের এক-তৃতীয়াংশ তােলার লক্ষ্যে গ্রেনভিল মন্ত্রীসভা স্ট্যাম্প অ্যাক্ট জারি করে । এই আইনে বলা হয় — আমেরিকার সমস্ত দলিলপত্র , চুক্তিপত্র ও লাইসেন্স – এ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কেনা স্টাম্প লাগাতে হবে , নতুবা তা আইনানুগ হবে না । এই কালা আইনের বিরুদ্ধে বােস্টনের আইনজীবী জেমস ওটিস বলেন — যেহেতু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকার কোনাে প্রতিনিধি নেই , তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ধার্য করা কোনাে কর দিতে আমেরিকানরা বাধ্য নয় ।
ঘোষণার অইিন ( ১৭৬৬ খ্রি. )
পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রকিংহ্যাম স্ট্যাম্প অ্যাক্ট প্রত্যাহার করে নেন । রকিংহ্যাম মন্ত্রীসভার রাজস্বমন্ত্রী চার্লস টাউনসেন্ট জারি করেন ঘােষণার আইন । এই আইনে বলা হয় উপনিবেশবাসীদের ওপর কর ধার্যের অধিকার রয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের । এই আইন অনুসারে আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে আমদানি করা চা , চিনি ও কাচের ওপর কর চাপানাে হয় ( ১৭৬৭ খ্রি. ) । এই ঘােষণার আইনের বিরুদ্ধে উপনিবেশবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে ।
বােস্টন টি পার্টি
আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ জুড়ে বিভিন্ন করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থ সমস্ত কর প্রত্যাহার করে নেন ( ১৭৭০ খ্রি. ) । কিন্তু উপনিবেশবাসীদের ওপর mother Country ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যে কর চাপানাের অধিকার রয়েছে তা বােঝানাের জন্যই তিনি শুধুমাত্র চায়ের ওপর পাউন্ড প্রতি ৩ পেনি কর বহাল রাখেন । এর প্রতিবাদস্বরূপ স্যামুয়েল অ্যাডামসের নির্দেশে বেশ কিছু উপনিবেশবাসী রেড ইন্ডিয়ানের ছদ্মবেশে এক রাতে ( ১৬ ডিসেম্বর , ১৭৭৩ খ্রি. ) ডার্টমাউথ নামক জাহাজে উঠে ৩৪২ পেটি চা সমুদ্রের জলে ফেলে দেয় । এই ঘটনা বােস্টন টি পার্টি নামে পরিচিত । এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার বােস্টন বন্দর বন্ধ করে দেয় ও বিভিন্ন দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে যা স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি গড়ে দেয় ।
স্বাধীনতার ঘোষণপত্র
ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার উপনিবেশগুলি ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে । জর্জিয়া ছাড়া আমেরিকার ১২টি উপনিবেশের ৫১ জন প্রতিনিধি ফিলাডেলফিয়া শহরে এক অধিবেশনে মিলিত হন ( ১৭৭৪ খ্রি. ৫ সেপ্টেম্বর ) । এই অধিবেশনেই ইংল্যান্ড-রাজ তৃতীয় জর্জের কাছে আমেরিকাবাসীদের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকারের আবেদন জানানাে হয় । কিন্তু তৃতীয় জর্জের কাছে উপনিবেশবাসীদের সব আবেদন ব্যর্থ হয় । ব্রিটিশ সৈন্যরা বােস্টনের কাছে লেক্সিংটন ও কনকর্ড নামক জায়গায় গুলি চালানাের ফলে বিদ্রোহের আগুন তীব্রতর হয়ে ওঠে । উপনিবেশবাসীরা জর্জ ওয়াশিংটনকে তাদের সেনাপতি নির্বাচিত করে টমাস জেফারসন রচিত ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘােষণা করে ( ১৭৭৬ খ্রি. ৪ জুলাই ) । অবশেষে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে ব্রিটিশ আমেরিকার উপনিবেশবাসীদের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয় ।
উপসংহার
আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে উপনিবেশবাসীদের সঙ্গে হল্যান্ড , ফ্রান্স ও স্পেন যােগ দিয়েছিল । কেন না উপনিবেশবাসীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় বাসিন্দার উৎসভূমি ছিল এইসব দেশগুলি । ব্রিটিশ সেনাপতি কর্নওয়ালিশের আত্মসমর্পনে ও জর্জ ওয়াশিংটন , টমাস জেফারসন , বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন , আলেকজান্ডার হ্যামিলটন , জন অ্যাডামস প্রমুখের সুদক্ষ নেতৃত্বের গুণে আমেরিকাবাসী স্বাধীনতার সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করল । স্বাধীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন ‘ জাতির জনক ’ জর্জ ওয়াশিংটন ।