মহাদেশীয় ব্যবস্থা বলতে কী বোঝো
মহাদেশীয় ব্যবস্থা বলতে কী বোঝো
ইংল্যান্ডের সামুদ্রিক বাণিজ্যকে স্তব্ধ করে তার সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিপর্যস্ত করার প্রচেষ্টায় নেপােলিয়ন বােনাপার্ট ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৮০৬ ও ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে মােট চারটি ( বার্লিন , ওয়ারশ , মিলান ও ফন্টেনব্লু ) ডিক্রি জারি করে যে অর্থনৈতিক অবরােধ গড়ে তােলেন , তাকেই মহাদেশীয় ব্যবস্থা বলা হয় । নেপােলিয়ন তাঁর সেনাপতি লেনমন্ট জেলার্ড এর অর্থনৈতিক অবরােধের রিপাের্টের ওপর ভিত্তি করে এই মহাদেশীয় অরবােধ প্রথার ছক কষেন ।

দোকানদারের জাত ইংরেজদের নেপােলিয়ন হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারতে চেয়েছিলেন । অর্থাৎ তিনি ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধির মূল উৎস যে বাণিজ্য সেই বাণিজ্য ব্যবস্থাকে মহাদেশীয় অবরােধ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন । এই লক্ষ্যে তিনি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।
বার্লিন ডিক্রি জারি
নেপােলিয়ন বার্লিন ডিক্রি জারি করে ( ১৮০৬ খ্রি. ১১ নভেম্বর ) বললেন , ফ্রান্সের বন্দরগুলিতে ইংল্যান্ড বা তার উপনিবেশগুলি থেকে আগত কোনাে জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না । এমনকি , ইংল্যান্ডে উৎপাদিত শিল্পজাত সামগ্রীও অন্য কোনাে দেশের জাহাজে করে ইউরােপে আনলে তা বাজেয়াপ্ত হবে ।
ইংল্যান্ডের জবাব — অর্ডার্স ইন কাউন্সিল
ইংল্যান্ড বার্লিন ডিক্রির জবাব হিসেবে অর্ডার্স ইন কাউন্সিল জারি করে ( ১৮০৭ খ্রি. ) , বলে — ইউরােপের কোনাে রাষ্ট্র ফ্রান্স বা ফ্রান্স অধিকৃত বন্দরে পণ্যসামগ্রী পাঠালে তা বাজেয়াপ্ত হবে । এই ঘােষণায় আরও বলা হয় , নিরপেক্ষ দেশের জাহাজ ব্রিটিশ বন্দরে এসে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত শুল্ক প্রদান করার পর ফ্রান্স ও তার মিত্র দেশগুলিতে যেতে পারবে ।
মিলান ডিক্রি ( ১৮০৭ খ্রি. )
নেপােলিয়ন আবার এর পালটা ব্যবস্থা হিসেবে মিলান ডিক্রি ( ১৮০৭ খ্রি. ডিসেম্বর ) জারি করে বলেন , অর্ডার্স ইন কাউন্সিল মান্যকারী যে – কোনাে দেশের জাহাজ বাজেয়াপ্ত করা হবে ।
ওয়ারশ ডিক্রি ( ১৮০৭ খ্রি. ) ও ফন্টেনব্লু ডিক্রি ( ১৮১০ খ্রি. )
নেপােলিয়ন পুনরায় এই দুই ডিক্রি জারির মাধ্যমে ঘােষণা করেন , ফ্রান্স অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে ব্রিটিশ পণ্যবাহী জাহাজ প্রবেশ করলে তা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে।
নেপােলিয়নের পতনে দায়িত্ব
মহাদেশীয় অবরােধ ব্যবস্থা জারির মাধ্যমে নেপােলিয়ন ইংল্যান্ডের সর্বনাশ করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন ।
মিত্র দেশগুলির বিরােধিতা
ব্রিটেনের শিল্পজাত পণ্যগুলি ছিল দামে সস্তা এবং মানের দিক থেকে উন্নত , তাই এই ধরনের পণ্যসামগ্রীগুলির অভাবে ইউরােপের বেশিরভাগ দেশের ব্যাবসাবাণিজ্য অচল হয়ে পড়ে । এর মধ্যে বেশ কিছু দেশ ফ্রান্সের মিত্র হলেও নেপােলিয়নের বিরােধিতা শুরু করে ।
পোপের বিরােধিতী
মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে পােপের সঙ্গে নেপােলিয়নের মতবিরােধ দেখা দেয় । এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নেপােলিয়ন পােপকে বন্দি করলে সমগ্র ক্যাথােলিক জগৎ নেপােলিয়নের ওপর রুষ্ট হয় ।
অর্ডার্স ইন কাউন্সিলের কার্যকারিতা
নেপােলিয়নের মহাদেশীয় অবরােধ নীতিকে কার্যত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইংল্যান্ড ফরাসি অর্থনীতিতে পালটা আঘাত হানার জন্য অর্ডার্স ইন কাউন্সিল জারি করেছিল । এলবাে থেকে এমস নদীর উপকূল বরাবর এক বিশাল অঞ্চল ব্রিটেন অবরুদ্ধ করে নেয় । এ ছাড়াও ব্রিটিশ অধীনস্থ বন্দরগুলিতে আটক হওয়া বিদেশি পণ্যসামগ্রীগুলি ব্রিটিশ বাণিজ্যের উপরি পাওনা হিসেবে বিবেচিত হয় । নিজেদের বিশাল ও শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে ফ্রান্স ও ফরাসি উপনিবেশগুলির ওপর ইংল্যান্ডের পালটা অবরােধ সফল হয় ।
স্পেনীয় যুদ্ধ
পোর্তুগাল ইংল্যান্ডের সঙ্গে গােপনে বাণিজ্যিক লেনদেন বজায় রাখলে নেপােলিয়ন স্পেনের মধ্যে দিয়ে পাের্তুগাল দখলের জন্য অভিযান শুরু করে । কিন্তু ফরাসি সেনাবাহিনী স্পেনের মধ্যে দিয়ে পাের্তুগাল যাবার পথে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্পেনের দখল নিলে শুরু হয় স্পেনীয় যুদ্ধ , যা নেপােলিয়নের পতনকে ডেকে আনে ।
রাশিয়া আক্রমণ
রাশিয়ার জার মহাদেশীয় প্রথা মানতে অস্বীকার করলে নেপােলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করে বসেন , পরিণাম স্বরূপ নেপােলিয়নের বিখ্যাত ‘ গ্র্যান্ড আর্মি ’ ধ্বংস হয়ে যায় । তাই ঐতিহাসিক লজ বলেছেন , একজন রাষ্ট্রনীতিবিদ হিসেবে নেপােলিয়নের অযােগ্যতার সর্বাধিক বড়াে প্রমাণ হল মহাদেশীয় অবরােধ ব্যবস্থা ( The Continental system was the most strupendous proof of Nepoleon’s Incapacity as a Statesman. ) ।