ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব বলতে কী বোঝো
Contents
ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব বলতে কী বোঝো
জিরন্ডিন দলের পতনের ( ১৭৯৩ খ্রি. মে ) পর ন্যাশনাল কনভেনশন বা জাতীয় মহাসভায় জ্যাকোবিন নামক সন্ত্রাসবাদী দলের শাসন শুরু হয় । জ্যাকোবিনের নেতৃত্বে জাতীয় মহাসভা অনুভব করে যে , প্রজাতন্ত্র ধরে রাখতে গেলে সবার আগে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে । আর তার জন্য প্রয়ােজন সন্ত্রাসের । এই ধারণা নিয়েই রােবসপিয়রের নেতৃত্বে জ্যাকোবিন দল ফ্রান্সের বুকে ১৩ মাস ( ১৭৯৩ খ্রি. ২ জুন — ১৭৯৪ খ্রি. ২৭ জুলাই ) ধরে সন্ত্রাসের শাসন চালায় । ঐতিহাসিক কেটেলবির মতে — এক ঘটনা পরম্পরার মাধ্যমে সন্ত্রাসের শাসনের সূচনা ঘটে ।

সন্ত্রাসের রাজত্বের পটভূমি
বহিরাক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের হাত থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করার জন্য রােবসপিয়রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের শাসন কায়েম হয় ।
বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা :
ইউরােপের অন্যান্য রাজতান্ত্রিক দেশগুলির ফ্রান্সে বিপ্লবী ভাবধারার অবসান ঘটাতে চাইলে সন্ত্রাসের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে ।
অভ্যন্তরীণ সংকট :
ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ৮৩ টি প্রদেশের মধ্যে ৬০ টি প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু হলে তা থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করার জন্য সন্ত্রাসের শাসনের সূচনা ঘটে ।
রাজতন্ত্রীদের বিদ্রোহ :
ফ্রান্সের সংবিধান কার্যকর ( ১৭৯১ খ্রি. ) হওয়ার সময় থেকেই রাজতন্ত্রীরা সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে । রাজতান্ত্রিক ভাবধারাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য সন্ত্রাসের শাসনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় ।
সেনাবাহিনীর দুর্বলতা :
রাজতন্ত্র , প্রজাতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রে যে – কোনাে ধরনেরই শাসনব্যবস্থারই রক্ষাকবচ হল সেনাবাহিনী । বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ সংকট উভয় ক্ষেত্রেরই মােকাবিলায় সেনাবাহিনী ব্যর্থ । তখন সন্ত্রাসের শাসন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে । দাঁতাে সন্ত্রাসের সমর্থনে যুক্তি দেখিয়ে বলেন রাষ্ট্রের উচিত ভয়ংকর হওয়া , যাতে জনগণ রাষ্ট্রের প্রতি ভয়ংকর না হয় ।
সন্ত্রাসের রাজত্বের সংগঠন
সন্ত্রাসের শাসনকে পরিচালনা ও কার্যকরী করার জন্য সাংগঠনিক ক্ষেত্রটিকে মজবুত রূপে গড়ে তােলা হয় ।
জননিরাপত্তা সমিতি :
সন্ত্রাসের সংগঠনের অন্যতম অঙ্গ এই জননিরাপত্তা সমিতির প্রথমে মােট সদস্যসংখ্যা ছিল ৯ জন , পরে তা বেড়ে হয় ১২ জন । এই সমিতির উল্লেখযােগ্য কয়েকজন সদস্য ছিলেন — রােবসপিয়র , সেন্ট জাস্ট , জর্জ কুথাে , রবার্ট লিন্ডেট , ভারেন প্রমুখ । এই সমিতির প্রধান কাজ ছিল শাসনব্যবস্থা পরিচালনা , মন্ত্রী , সেনাপতি , রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ , বিদেশনীতি নিয়ন্ত্রণ , বৈদেশিক যুদ্ধ পরিচালনা ইত্যাদি ।
সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি :
সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি ন্যাশনাল কনভেনশনের সময় গঠিত হয় ( ১৭৯৩ খ্রি. ) । এই সমিতি সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি করত এবং তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়ােগ করত । এই কমিটি সারা দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতি দৃষ্টি রাখত । এই সমিতির কাজে সাহায্য করত প্রচুর বিপ্লবী সমিতি , কমিউন ও পুলিশ বিভাগ ।
বিপ্লবী কমিটি :
সন্দেহের আইন অনুযায়ী প্রজাতন্ত্র বিরােধী ও রাজতন্ত্রের সমর্থকরূপে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হত । বিপ্লব বিরােধী সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেফতারের জন্য সমগ্র ফ্রান্সে ৫০ হাজার বিপ্লবী কমিটি গঠিত হয়।
বিপ্লবী আদালত :
সন্দেহের আইনে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের বিপ্লবী আদালতে এনে বিচার করা হত । সাধারণ আদালতের রায়কে অগ্রাহ্য করে প্রজাতন্ত্র বিরােধী সন্দেহভাজনদের দ্রুত বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে বিপ্লবের বদ্ধভূমিতে পাঠাত এই ফৌজদারি আদালতটি ।
সন্ত্রাসের রাজত্বের নৃশংসতা
ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল এক রক্তাক্ত অধ্যায় । সন্ত্রাসের বলি হয়েছিল আনুমানিক ৩৫-৪০ হাজার নরনারী । এর মধ্যে বহু নির্দোষ ব্যক্তিও ছিলেন ।
- বিপ্লবের বলি হয়েছিলেন — জিরােন্ডিন দলের পরামর্শদাত্রী মাদাম রোলাঁ , ডিউক অফ অর্লিয়াঁ , দার্শনিক কুঁড়ে , সম্রাট লুই – এর ভাই ফিলিপ , বিজ্ঞানী বেইলি , গিলােটিন যন্ত্রের অবিষ্কর্তা ড. গিলােটিন এবং সন্ত্রাসের নায়ক রােবসপিয়র ।
- জ্যাকোবিন দলের নেতা হিবার্ট ও দাঁতো সন্ত্রাসের বিরােধিতা করলে তাঁদেরকেও ( ১৭৯৪ খ্রি. মার্চ ও এপ্রিল ) রােবসপিয়র গিলােটিনে হত্যা করেন ।
- লায়নস্ , লা ভেন্ডির প্রজাবিদ্রোহকে নৃশংসভাবে দমন করা হয় ।
- মেরি আঁতােয়ানেতসহ রাজপরিবারের সকল সদস্যকেই গিলােটিনে হত্যা করা হয় ।
থার্মিদোরীয় প্রতিক্রিয়া
জ্যাকোবিন নেতা রােবসপিয়রের নির্দেশে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যালীলা সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে । জ্যাকোবিন দলের সদস্য ও অনুগামীরা পর্যন্ত রােবসপিয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে । কোচ – এর নেতৃত্বে রােবসপিয়র বিরােধী দাঁতো ও হিবার্টপন্থীরা বুর্জোয়া প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ( ৯ থার্মিদোর বা ১৭৯৪ খ্রি. ২৭ জুলাই ) রােবসপিয়রকে বন্দি করে এবং পরের দিন ২৮ জুলাই তাঁকে গিলােটিনে হত্যা করা হয় । রােবসপিয়রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে । বিপ্লবী ক্যালেন্ডারে থার্মিদোরীয় মাসে রােবসপিয়রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটেছিল বলে এটি থার্মিদোরীয় প্রতিক্রিয়া নামে খ্যাত । ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই থেকে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর পর্যন্ত সময়কাল হল — থার্মিদোরীয় প্রতিক্রিয়ার যুগ । আলফ্রেড কোব্যানের মতে থার্মিদোর ছিল একটি প্রতিবিপ্লব ( Thermidor was a counter revolution )।
সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রকৃতি
ফ্রান্সে সন্ত্রাসের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে । প্রকৃত অর্থে সন্ত্রাসের শাসন ছিল এক সাময়িক ব্যবস্থা । অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পরিস্থিতির চাপেই সন্ত্রাসের উদ্ভব ঘটেছিল আর পরিস্থিতির পরিবর্তনেই তার বিনাশ ঘটেছিল । লেফেভর , মঁতিয়ে , জোরেস প্রমুখের মতে — অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বিপ্লবের চরিত্রকে পরিবর্তিত ও বিস্তৃত করেছিল । সন্ত্রাসের রাজত্বে স্বাধীনতার অপমৃত্যু প্রসঙ্গে মাদাম রোঁলা বলেছিলেন — হায় স্বাধীনতা , তােমার নাম নিয়ে কত অনাচার না করা হচ্ছে !
সন্ত্রাসের রাজত্বের সমালোচনা
ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালােচিত হয়েছে ।
- দেশের সংকটমােচনে ও অরাজকতার অবসানে সন্ত্রাসের সাময়িক প্রয়ােজনীয়তা থাকলেও ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে নতুন জননিরাপত্তা সমিতি গঠিত হওয়ার পর সন্ত্রাসের প্রয়ােজনীয়তা ফুরােয় । কিন্তু রােবসপিয়র ক্ষমতায় টিকে থাকার মােহে সন্ত্রাস কায়েম রাখেন ।
- সন্ত্রাসের শাসন নামক নৃশংস অধ্যায়ের শেষ পর্বে যখন বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দূর হয়েছে বা জিরােন্ডিন , মুনাফাবাজ , প্রতিবিপ্লবীদের দমন করা গেছে তখনও সন্ত্রাসের নিষ্ঠুর হত্যালীলা চালানাে উচিত হয়নি ।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্দেহের আইনে ধৃতদের বিনাবিচারে বা বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে গিলােটিনে হত্যা করা হয়েছে , যা কখনােই সমর্থনযােগ্য নয়।
- সন্ত্রাসের রাজত্বে একশ্রেণির উৎশৃঙ্খল , দায়িত্বজ্ঞানহীন , প্রতিহিংসাপরায়ণ , অপদার্থ ব্যক্তি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে । সবরকম সংযম , শালীনতা , ধৈর্য , মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে এরা যেভাবে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিল , যে – কোনাে সভ্য সমাজব্যবস্থার কাছেই তা ছিল এক ভয়ংকর অভিশাপের মতাে ।
- মানবজাতির স্বাধীনতা ও সাম্যের অধিকারের বিরােধী ছিল সন্ত্রাস । কীসের জোরে , কোন্ আইনে শত সহস্র নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হল তার যুক্তিসম্মত উত্তর দিতে ব্যর্থ হয় সন্ত্রাস ।
- সন্ত্রাসের প্রয়ােজনীয়তা মিটে যাওয়ার পরেও তা চালিয়ে যাওয়ায় সাধারণ ফরাসিবাসী আশঙ্কিত হয় । জনগণের জন্যই বিপ্লব , তাই তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করায় সন্ত্রাস লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল বলা চলে । তাই , লুই ব্লাঁ ( Louis Blanc ) বলেছেন – সন্ত্রাস ফ্রান্সকে বাঁচায়নি , সন্ত্রাস বিপ্লবকে পঙ্গু করে দেয় ।
উপসংহার
ফ্রান্সে বিপ্লবের ফলে যেসব পরিবর্তন ঘটেছিল , সেগুলি রক্ষা করতে পেরেছিল সন্ত্রাসের শাসন । বিদেশি আক্রমণের ভীতি ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ যখন ফ্রান্সকে এক সংকটের মুখে ঠেলে দেয় , তখন সন্ত্রাসই দেশকে রক্ষা করে । সন্ত্রাসের শাসনের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক হেইজ বলেন — সন্ত্রাসের মাধ্যমেই ফ্রান্সে বিপ্লব রক্ষা পায় এবং ইউরােপে ফ্রান্স জয়যুক্ত হয় (‘The Revolution was preserved in France , and France was victorious in Europe by the terror’) .