নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি আলোচনা করো

নেপোলিয়নের সংস্কার গুলি আলোচনা করো

নেপােলিয়ন বােনাপার্ট একজন সুশাসক , দক্ষ সংগঠক , সমরকুশলী সেনানায়করূপে খ্যাতি অর্জন করলেও মূলত সংস্কারক ও প্রশাসক হিসেবে ফ্রান্স তথা বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন । ১৭৯৯-১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরােপের ইতিহাস বলতে বােঝায় ফ্রান্সের ইতিহাসকেই এবং ফ্রান্সের ইতিহাস হল মূলত নেপােলিয়নেরই ইতিহাস । ঐতিহাসিক এইচ. এ. এল. ফিশারের  মতে — তাঁর সাম্রাজ্য ক্ষণস্থায়ী হলেও ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের স্থায়ী ভিত্তির ওপর নির্মিত ( ‘ If the conquests were ephemeral , his civillian work in France was built upon granite ’ ) I

images
নেপােলিয়ন বােনাপার্ট

নেপােলিয়নের সংস্কারের লক্ষ্য

নেপােলিয়নের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের লক্ষ্য ছিল—

  1. ফ্রান্সে এক কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলে প্রজাকল্যাণকর কাজের মাধ্যমে ফরাসিজাতির কৃতজ্ঞতা ভাজন হওয়া ।
  2. অভ্যন্তরীণ সংস্কারসাধনের মাধ্যমে সম্রাট হিসেবে নিজের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বাড়ানাে ।
  3. প্রচলিত শাসনব্যবস্থা , অর্থনীতি , শিক্ষা , ধর্মীয় ও অন্যান্য ব্যবস্থার ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলিকে দূর করে এক শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা ।
  4. বেশ কিছু নতুন নীতি ও সংস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে ফ্রান্সে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা ।

নেপােলিয়নের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার

নেপােলিয়নের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারগুলি ছিল —

  1. কনসুলেটের সংবিধান প্রবর্তনের পর ( ১৭৯৯ খ্রি. ) নেপােলিয়ন রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়ে এক কেন্দ্রীভূত স্বৈরশাসন গড়ে তােলেন ।
  2. পূর্বেকার মতােই ফ্রান্স ৮৩ টি প্রদেশে বিভক্ত থাকে । নেপােলিয়ন এইসব প্রদেশের শাসক হিসেবে প্রিফেক্ট , জেলাগুলির শাসক সাব – প্রিফেক্ট , কমিউনের শাসক মেয়রসহ বিভিন্ন সরকারি উচ্চপদগুলিতে মনােনয়ন অর্থাৎ নিজের পছন্দমতাে ব্যক্তিদের নিয়ােগ শুরু করেন ।
  3. কর্মচারীদের নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়ােগের প্রথা বাতিল করে দিয়ে মনােনয়নের মাধ্যমে নিজের পছন্দমতাে কর্মচারী নিয়ােগ শুরু হয় ।
  4. প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা , বিদেশনীতি নির্ধারণ , এমনকি আইন প্রণয়ন বিষয়ক সব ক্ষমতাই নেপােলিয়ন নিজের হাতে তুলে নেন ।
  5. প্রাদেশিক ও পৌরসভাগুলির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ও ক্ষমতার হ্রাস ঘটানাে হয় ।

নেপােলিয়নের অর্থনৈতিক সংস্কার

অর্থনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে নেপােলিয়ন বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন —

  1. তিনি সমস্ত সরকারি দফতরের খরচ কমানাের নির্দেশ দেন ।
  2. সরকারি অর্থ দফতরকে রাজস্ব ও অডিট এই দুই ভাগে ভাগ করেন ।
  3. আর্থিক বিপর্যয়কে সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে প্যারিসের ব্যাংক বিশেষজ্ঞ পেরেগঁর ( Perregoux ) – এর গঠনতান্ত্রিক খসড়া অনুসরণে প্রতিষ্ঠা করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ( Bank of France ) ( ১৮০০ খ্রি. ) । ‘ অ্যাসাইনেট ’ নামক কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে এই ব্যাংক নতুন নােট ছাপাবার একচেটিয়া অধিকার পায় ।
  4. অর্থনীতিকে পুনরায় মজবুত করার লক্ষ্যে নতুন করে কর চাপানাের পরিবর্তে পুরােনাে বকেয়া পরােক্ষ কর আদায়ের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয় ।
  5. রাজস্ব আদায়ের অধিকার প্রাদেশিক সভার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত করা হয় ।
  6. বেকার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন জাতীয় পরিকল্পনা গৃহীত হয় এবং বেকারদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয় ।
  7. মুদ্রাব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সােনা ও রূপার মুদ্রার পুনঃপ্রচলন ঘটানাে হয় ।
  8. বণিক সংঘের পুনর্গঠন , নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ , স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন ও বন্দরগুলির সংস্কারসাধন করে নেপােলিয়ন ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির চেষ্টা করেন ।

নেপােলিয়নের আইন সংহিতা — কোড নেপােলিয়ন 

আইন  ও  বিচারব্যবস্থার নেপােলিয়নের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল ২৮৭ টি ধারাবিশিষ্ট ‘ আইন সংহিতা ’ সংকলন ( ১৮০৪ খ্রি. ) । নেপােলিয়ন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে এই আইন সংহিতার নাম দেন ‘ কোড নেপােলিয়ন ’। ফ্রান্সের চারজন বিশিষ্ট আইনজীবী চার বছর ( ১৮০০-১৮০৪ খ্রি. ) ধরে ৮৪ টি অধিবেশনে মিলিত হয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই ‘ আইন সংহিতা ’ ( Code Nepoleon ) টি সংকলন করেন ।

কোড নেপােলিয়নের ভিত্তি :

আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমানাধিকার , ধর্মীয় সহনশীলতা , উত্তরাধিকার ক্ষেত্রে সাম্য , জীবিকার স্বাধীনতা , কৃষকদের মালিকানা স্বত্ব প্রদান ইত্যাদি বিপ্লবী আদর্শের ওপর ভিত্তি করে এটি রচিত ।

কোড নেপােলিয়নের বিভাগ :

আইন সংহিতাটি দেওয়ানি , ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক এই তিনভাগে বিভক্ত ছিল ।

কোড নেপােলিয়নের গুরুত্ব :

এই কোড নেপােলিয়নের গুরুত্ব ছিল —

  1. ফরাসি ও রােমান আইনের সমন্বয়ে গঠিত ‘ কোড নেপােলিয়ন ’ ফ্রান্স থেকে সামন্ততন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে দেয় । এই আইন সংহিতার গুরুত্ব প্রসঙ্গে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত অবস্থায় নেপােলিয়ন বলেন- “ আমার যে কাজ চিরস্থায়ী হবে তা হল আইন সংহিতা । ”
  2. এই আইন সংহিতার মাধ্যমে নেপােলিয়ন বিপ্লবের সুফল ফরাসিবাসীর হাতে তুলে দেন ।
  3. ইতালি , জার্মানি , হল্যান্ডসহ ইউরােপের বহু দেশের আইনবিধি এই আইন সংহিতাকে অনুসরণ করে সংশােধন করা হয়েছিল । এই আইনবিধির প্রশংসা করে লেফেভর বলেন— আইন সংহিতা সমাজের বাইবেলে পরিণত হয় ( ‘ The Civil Code became the Bible of the society ’ ) I

নেপােলিয়নের বিচার সংস্কার

  1. বিচারের ক্ষেত্রে সকলের প্রতি সমতার নীতি প্রবর্তিত হয় ।
  2. বিচারের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রচুর নতুন আদালত গড়ে তােলা হয় ।
  3. জুরির সাহায্যে বিচারের ব্যবস্থা চালু হয় ।
  4. প্রকাশ্যে বিচারের রীতি প্রবর্তিত হয় ।

নেপােলিয়নের শিক্ষাসংস্কার

শিক্ষাবিদ কন্দারসেট পরিকল্পিত জাতীয় শিক্ষানীতিকে নেপােলিয়ন অনুকরণ করেন ।

  1. প্রতিটি কমিউন ( পুরসভা ) – এ একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।
  2. লাইসি ’ নামে ৪৫ টি মডেল আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তুলে বেসামরিক ও সামরিক শিক্ষাব্যবস্থার মেলবন্ধন ঘটানাে হয় । সেখানে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে বেছে বেছে ছাত্র ভরতি করা হত ।
  3. শিক্ষক – শিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল ও চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য যথাক্রমে ছটি বিদ্যালয় গড়ে তােলা হয় ।
  4. কারিগরি ও স্বাস্থ্যবিদ্যায় শিক্ষিত করে তােলার জন্য যথাক্রমে একোল পলিটেকনিক ( Ecole Politechnique ) ও চিকিৎসা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ।
  5. ফরাসিবাসীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে নেপােলিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব ফ্রান্স ( ১৮০৮ খ্রি. ) ।

নেপােলিয়নের ধর্মসংস্কার

ফরাসি সংবিধান সভা গির্জার রাষ্ট্রীয়করণ করে ( ১৭৯১ খ্রি. ) পােপের সঙ্গে যে বিবাদের সৃষ্টি করেছিল নেপােলিয়ন তার অবসান চেয়েছিলেন । এই লক্ষ্যে নেপােলিয়ন পােপ সপ্তম পায়াসের সঙ্গে এক ধর্মমীমাংসা চুক্তি বা কনকর্ডাট ( ১৮০১ খ্রি. ) – এ আবদ্ধ হন । এতে বলা হয় —

  1. রােমান ক্যাথােলিক চার্চ ও ধর্মমতকে ‘ ফরাসিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ’- রুপে ফরাসি সরকার স্বীকৃতি দেবে ।
  2. পােপ গির্জা ও তার সম্পত্তির জাতীয়করণ মেনে নেবেন ।
  3. যাজকদের সরকার মনােনীত করবেন এবং পােপ তাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানাবেন ।
  4. ফ্রান্সকে পঞ্চাশটি যাজক গােষ্ঠীতে ভাগ করে সরকার কর্তৃক যাজকদের বেতনদানের ব্যবস্থা করা হয় ।
  5. প্রােটেস্ট্যান্ট ও ইহুদিদের সঙ্গে ধর্মীয় সুসম্পর্ক গড়ে তােলা হয় , এতে ফরাসিবাসীর ধর্মাচরণের স্বাধীনতা স্বীকৃতি পায় ও রাষ্ট্ররূপে ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র স্বীকৃতি অর্জন করে । জেনারেল অব পাবলিক ওয়রশিপ নামে আদেশ জারির ( ১৮০২ খ্রি. ) মাধ্যমে নেপােলিয়ন কনকর্ডাট – এর বাস্তবায়ন ঘটান ।

নেপােলিয়নের অন্যান্য সংস্কার

নেপােলিয়নের অন্য সংস্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল —

  1. রাষ্ট্রের প্রতি সেবা , আনুগত্য ও অন্যান্য যােগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ নেপােলিয়ন ‘ লিজিয়ন অব অনার ’ নামক এক বিশেষ ধরনের খেতাব প্রবর্তন করেন এবং সাধারণ ফরাসিবাসীকেও প্রিন্স , মার্শাল প্রভৃতি উপাধি দানের রীতি প্রচলন করেন ।
  2. বহু রাস্তা , সেতু তিনি নির্মাণ করান , তার মধ্যে আল্পস পর্বতের পথে বিখ্যাত আলপাইন হাইওয়ে ছিল অন্যতম ।
  3. প্যারিসের লাভের জাদুঘরকে তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুঘরে পরিণত করেন ।
  4. ফ্রান্সের প্রাচীন সৌধগুলির সংস্কার ছাড়াও তিনি বহু নতুন সৌধ , অট্টালিকা , উদ্যান তৈরি করান ।

উপসংহার

সংস্কারক হিসেবে নেপােলিয়ন পুরােনােকে অবহেলা করে শুধুমাত্র নতুনকে আবাহন করেননি বা যুগের প্রয়ােজনকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র পুরােনােকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাননি । পুরােনাের সঙ্গে নতুনের এক অদ্ভুত সমন্বয়সাধনই ছিল তাঁর সংস্কারের মূল সুর । ডেভিড থমসনের  মতে — বােনাপার্ট ফ্রান্সকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেন এবং আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন (‘ Bonaparte disciplined France and established order ’) ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

error: Content is protected !!