আকবর এর কৃতিত্ব আলোচনা কর

আকবর এর কৃতিত্ব আলোচনা কর

index 36
আকবর

বাবর ভারতবর্ষে যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা হুমায়ুনের আমলে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । আকবর পুনরায় নিজ বাহুবলে ও বুদ্ধিবলে মােগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন । এই সাম্রাজ্য বহুদিন টিকে ছিল । আকবর মােগল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করলে ভারতে মােগল আক্রমণ একটি ‘Episode’- এ পরিণত হত । তাই আকবরকে ভারতে মােগল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় ।

ভারতের ইতিহাসে আকবরের স্থান

সম্রাট আকবর ছিলেন মধ্যযুগে ভারতের শ্রেষ্ঠ শাসক এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম । মােগল সাম্রাজ্যের স্থপতি জহির – উদ্দিন – মহম্মদ বাবর তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পুত্র হুমায়ুনকে এক গােপন ইচ্ছাপত্রে বলেন , হুমায়ুন , তুমি সত্যিই সৌভাগ্যশালী , বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাসভূমি হল ভারত , তােমার ওপর ভগবানের অপার করুণায় সেই দেশের শাসনভার অর্পিত হয়েছে । সুতরাং , তােমার কর্তব্য হল সব রকমের  সংকীর্ণতা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা ; সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক স্পর্শকাতরতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা ; সকল সম্প্রদায়ের উপাসনার পবিত্র স্থানগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করা । তাহলেই প্রজাদের সঙ্গে রাজার সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে । হুমায়ুন এই নির্দেশ যথাযথ পালনের সময় পাননি । কিন্তু  আকবর এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে এক জাতীয় নীতির প্রবর্তন করেন । সহজাত প্রতিভা , মৌলিক চিন্তা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন ।

জাতীয় রাষ্ট্র গঠন

( 1 ) আকবরের মহান কৃতিত্ব হল জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপনের উদ্যোগ । নিছক জাতিগত গৌরব প্রতিষ্ঠার বাসনা নয় ; সমগ্র ভারতবর্ষকে এক – আইন ও এক – শাসনের অধীন করে একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের কাজ তিনিই সম্পন্ন করেন । ভারতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শ তিনিই প্রথম গ্রহণ করেন । আগ্রা ও দিল্লির শিথিল রাজ্য নিয়ে তিনি শাসন শুরু করেছিলেন । মৃত্যুকালে সেই সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল হিমালয় থেকে নর্মদা , আর হিন্দুকুশ থেকে ব্ৰহ্মপুত্র পর্যন্ত ।

( ii ) খ্রিস্টান পাদরি দ্য জ্যারী  লিখেছেন , জাতিধর্মনির্বিশেষে সমস্ত মানুষের ভালােবাসা ও আস্থার ওপর তিনি এই সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তুলেছিলেন । অধ্যাপক কে. টি. শাহ  লিখেছেন , সম – অধিকার ও সম – কর্তব্যবােধ দ্বারা তিনি ভারতের দুটি প্রধান সম্প্রদায়কে একসূত্রে গ্রথিত করতে সক্ষম হন । হিন্দুদের ওপর থেকে তীৰ্থকর বিলােপ ( ১৫৬৩ খ্রি. ) এবং জিজিয়া কর বিলােপ ( ১৫৬৪ খ্রি. ) দ্বারা তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবাসীকে আপন করে নেন । উত্তর , মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে তিনি অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেন । তিনি ফারসি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করে এবং সকল রাজকর্মচারীকে ফারসি শিখতে বাধ্য করে সাম্রাজ্যের মধ্যে ভাষাগত ঐক‍্যের চেষ্টা করেন । এইসব কারণেই আকবরকে জাতীয় সম্রাটের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ।

উদার শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

রাজ্যজয়ের পাশাপাশি একটি সুসংহত শাসনকাঠামাে প্রবর্তন করে রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলবিধানের কাজে তিনি দক্ষতা দেখান । আকবরের শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ন্যায় , সাম্য এবং সহনশীলতা । তিনি মনসবদারি প্রথার প্রচলন করে মােগল আমলাতন্ত্রকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেন । জমি জরিপ , কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি দ্বারা তিনি সাধারণ মানুষকে কষ্ট না দিয়ে রাজকোশকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন । তাঁর আমলে হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তি , নিরাপত্তা ও প্রগতির সুযােগ পায় ।

সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ

আকবর সম্ভবত নিরক্ষর ছিলেন । কিন্তু তাঁর প্রজ্ঞা ছিল গভীর । ইতিহাস , ধর্মতত্ত্ব , দর্শন , কাব্যসাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জনে তাঁর একান্ত আগ্রহ ছিল । জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অকৃত্রিম । শিল্প , স্থাপত্য , চিত্রকলার প্রতিও তাঁর অনুরাগের অভাব ছিল না । আবুল ফজল  লিখেছেন , শিল্প , স্থাপত্য , চিত্রকলার প্রতি আকবরের আগ্রহ ছিল আন্তরিক । মােগল – শিল্পকে বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসারী করার কাজে তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক । মােগল যুগে ভারতীয় সংস্কৃতির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে আকবরের রাজত্বকালে । তিনি অনুবাদ – দপ্তর স্থাপন করে সংস্কৃত ও আরবি গ্রন্থগুলির ফারসি অনুবাদের ব্যবস্থা করেন । আকবরের রাজসভা বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি অলঙ্কৃত করেছিলেন । বিক্রমাদিত্যের রাজসভার মতাে ‘ নবরত্ন ’ আকবরের রাজসভাতেও ছিল । আকবরের সভার নবরত্নরা হলেন কবি ও সাহিত্যিক ফৈজি , ঐতিহাসিক আবুল ফজল , পরামর্শদাতা বিহারীমল , অর্থনীতিবিদ টোডরমল , বহুভাষাবিদ আব্দুর রহিম , রসিক বিরবল , সংগীতজ্ঞ তানসেন , পারস্যদেশীয় কবি হাকিম হুমায়ুন , বিদূষক মােল্লা – দো – পিয়াজি

ধর্মসহিষ্ণুতা

আকবরের ‘ সর্বধর্মসহিষ্ণুতা ‘ এবং ‘ সুলহ – ই – কুল ’ নীতির মধ্যেও ‘ ভারতবােধ ’ জাগ্রত ছিল । তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে , ধর্মীয় বিভেদ ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের পথে প্রধান বাধা । তাই তিনি দীন – ই – ইলাহী নামক সমন্বয়ী দর্শন প্রচার করে জাতীয় ঐক্য বিধানে সচেষ্ট হয়েছিলেন । তাঁর এই সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রচেষ্টাই তাঁকে একজন মহান সম্রাটে পরিণত করেছিল । ‘ ভারতীয় রাজা ’ হয়ে না থেকে ভারতের রাজা হওয়ার মহান লক্ষ্য আকবরের কর্মধারার মধ্যে প্রথম প্রকাশ লাভ করে । সমস্ত দিক বিচার করে ঐতিহাসিক ঈশ্বরীপ্রসাদ   বলেছেন যে , আকবর শুধুমাত্র ভারতের ইতিহাসে নয় , সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী । অধ্যাপক হীরেন মুখােপাধ্যায়  যথার্থই লিখেছেন — আকবরের সমসাময়িক ছিলেন ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ , ফ্রান্সের চতুর্থ হেনরি এবং পারস্যে মহামতি আব্বাস । আকবরের কৃতিত্ব ও চরিত্রভাতির কাছে এরা ম্লান হয়ে যান ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

x
error: Content is protected !!