শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা বা শেরশাহের কৃতিত্ব
শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা বা শেরশাহের কৃতিত্ব

মােগলবংশীয় হুমায়ুনকে পরাজিত ও বিতাড়িত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন আফগান বীর শের খাঁ । সিংহাসনে বসে তিনি শেরশাহ উপাধি নেন । তাঁর নেতৃত্বে ভারতে স্বল্পকালের জন্য আফগান শাসনের পুনঃ প্রতিষ্ঠা ঘটে । ড. কে. কে. কানুনগাে শেরশাহকে আফগানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসনিক ও সামরিক প্রতিভাসম্পন্ন বলে উল্লেখ করেছেন । উইলিয়াম আরস্কিন মন্তব্য করেছেন , আইনপ্রণেতা ও নিরাপত্তার রক্ষক হিসেবে শেরশাহ্ আকবরের পূর্ববর্তী মুসলমান শাসকদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন ।
শেরশাহের কেন্দ্রীয় শাসন সংস্কার
কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং । তিনি ছিলেন সকল শক্তির আধার । ঐতিহাসিক ত্রিপাঠীর মতে , শেরশাহ যতই কর্মঠ এবং পরিশ্রমী হােন না কেন তাঁর পক্ষে একা সব কাজ দেখাশােনা করা সম্ভব ছিল না । রাজকাজে সাহায্যের জন্য তিনি কয়েকজন মন্ত্রী নিয়ােগ করেন—
( i ) দেওয়ান-ই-ওয়াজিরৎ ( যিনি অর্থ বিভাগ দেখাশুনা করতেন ) ;
( ii ) দেওয়ান-ই-আরিজ ( যিনি সেনা বিভাগ দেখাশুনা করতেন ) ;
( iii ) দেওয়ান-ই-ইনসা ( সরকারি দলিল ও চিঠিপত্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ) ;
( iv ) দেওয়ান-ই-রসালৎ ( পররাষ্ট্র মন্ত্রী ) । এ ছাড়া দেওয়ান – ই – কাজী , বারিদ – ই – সুমালিক ইত্যাদি উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিল ।
শেরশাহের প্রাদেশিক শাসন সংস্কার
( i ) শাসনের সুবিধার জন্য শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি শিক বা সরকারে বিভক্ত করেন । প্রতিটি সরকারে শিকদার-ই-শিকদারান এবং মুনসিফ-ই-মুনসিফান নামক দুজন প্রধান কর্মচারী থাকতেন । তাঁরা যথাক্রমে সাধারণ প্রশাসন এবং বিচার ও রাজস্ব বিভাগ তত্ত্বাবধান করতেন ।
( ii ) প্রতিটি সরকার আবার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল । প্রতিটি পরগনায় শিকদার ও মুনসিফ নামক দুজন প্রধান কর্মচারী থাকতেন । তাঁদের সাহায্য করতেন কারকুন , আমিন , কানুনগাে , ফোতেদার নামক কর্মচারীরা ।
( iii ) শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম । খুৎ , মুকদ্দম , চৌধুরী , পাটোয়ারী প্রমুখ কর্মচারী গ্রাম – শাসনের কাজে নিযুক্ত থাকতেন । গ্রামশাসনে পঞ্চায়েতের বিশেষ ভূমিকা ছিল । কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য বছর অন্তর তাদের বদলি করা হত ।
শেরশাহের রাজস্ব সংস্কার
শেরশাহ রাজস্ব ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার করেন ।
( i ) রাজস্ব নির্ধারণের জন্য তিনি সমস্ত জমি জরিপের ব্যবস্থা করেন ।
( ii ) উৎপাদিকা শক্তি অনুযায়ী জমিগুলিকে উৎকৃষ্ট , মাঝারি ও নিকৃষ্ট এই তিন ভাগে ভাগ করেন । উৎপন্ন শস্যের তিন ভাগের এক ভাগ বা চার ভাগের এক ভাগ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হয় । নগদ টাকা বা উৎপন্ন দ্রব্যে রাজস্ব দেওয়া যেত । এই রাজস্ব সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয় । এর ফলে মধ্যস্বত্বভােগী – শ্রেণির শােষণ থেকে কৃষকেরা মুক্তি পায় ।
( iii ) জমির দাগ নম্বর , প্রজার নাম , জমির স্বত্ব ও দেয় রাজস্ব উল্লেখ করে প্রজাকে পাট্টা নামে একটি দলিল দেওয়ার ব্যবস্থা হয় । পরিবর্তে কৃষকও রাজস্ব প্রদানের অঙ্গীকার – সহ একটি কবুলিয়ত সরকারকে দিতে বাধ্য থাকে ।
( iv ) দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হলে রাজস্ব মকুব করা হত ।
( v ) তখন ভারতে নানা ধরনের মুদ্রা চালু ছিল । মুদ্রাগুলিতে ধাতুর মানও নির্দিষ্ট ছিল না । শেরশাহ সােনা , রুপা ও তামার নতুন মুদ্রা চালু করেন । মুদ্রাগুলির মান ( value ) নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । তামার মুদ্রাগুলি ‘ দাম ‘ নামে পরিচিত ছিল ।
শেরশাহের বিচার সংস্কার
( i ) শেরশাহের বিচারব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ ও উন্নতমানের । আইনের চোখে সকলেই ছিল সমান । বিচারক্ষেত্রে জাতি , ধর্ম বা ব্যক্তির মধ্যে বৈষম্য করা হত না ।
( ii ) বিচারব্যবস্থার চূড়ায় ছিলেন সম্রাট শেরশাহ স্বয়ং । তবে বিভিন্ন স্তরে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন ।
( iii ) প্রতিটা পরগনায় দেওয়ানি বিচারের দায়িত্ব ছিল আমিন নামক কর্মচারীর ওপর এবং ফৌজদারি বিচারের ভার ছিল কাজী ও মীর আদল – এর ওপর ।
( iv ) কয়েকটি পরগনার ওপর দেওয়ানি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন মুনসিফ – ই – মুনসিফান নামক কর্মচারী এবং ফৌজদারি বিচারের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন কাজউকাজাতন বা প্রধান কাজী ।
( v ) শেরশাহের আমলে দণ্ডবিধির কঠোরতা ছিল । বেত্রাঘাত , অঙ্গচ্ছেদ এবং প্রাণদণ্ড দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল ।
শেরশাহের সেনাবাহিনীর সংস্কার
( i ) শেরশাহের সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শৃঙ্খলা পরায়ণ । তিনি আলাউদ্দিনের সামরিক রীতির অনুকরণে সেনাবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন অংশের সেনানিবাসে মােতায়েন রাখতেন ।
( ii ) প্রতিটি সেনানিবাসের দায়িত্বে ছিলেন একজন করে ফৌজদার । এ ছাড়া সম্রাটের অধীনে ছিল ২৫ হাজার পদাতিক ও দেড় লক্ষ অশ্বারােহীর এক বিশাল ও সুদক্ষ বাহিনী ।
( iii ) যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রার ফলে ফসল বা সম্পত্তির ক্ষতি হলে শেরশাহ্ রাজকোশ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রীতি চালু করেন ।
শেরশাহের পুলিশবাহিনীর সংস্কার
দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষার ভার ছিল পুলিশবাহিনীর হাতে । শেরশাহ গ্রামাঞ্চলের শান্তি – শৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রামের মােড়লদের ওপর অর্পণ করেছিলেন । গ্রামে গ্রাম – পঞ্চায়েত ও গ্রাম – প্রধান শান্তি – শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করতেন । সরকারি কর্মচারীরা দেশে চুরি – ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তাদেরই শাস্তি দেওয়া হত । ফিরিস্তা লিখেছেন , শেরশাহের আমলে পুলিশ ব্যবস্থা এতই দক্ষ ছিল যে , পর্যটকরা পথের ধারেই তাদের মূল্যবান দ্রব্যাদি রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমােতে পারতেন । এই বক্তব্য হয়তাে কিছুটা অতিরঞ্জিত ; কিন্তু এ থেকে তখনকার উন্নত আইন – শৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারণা করা যায় ।
যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি
( i ) সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধার জন্য শেরশাহ বহু রাস্তা নির্মাণ করেন । এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বাংলার সােনার গাঁ থেকে সিন্ধুপ্রদেশ পর্যন্ত নির্মিত রাস্তা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রােড । এ ছাড়া আগ্রা থেকে যােধপুর , আগ্রা থেকে বুরহানপুর প্রভৃতি রাস্তাও শেরশাহের অমর কীর্তি । এর ফলে অভ্যন্তরীণ ব্যাবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতিও সম্ভব হয় ।
( ii ) পথচারীদের সুবিধার জন্য রাস্তার দু – পাশে তিনি সারি সারি গাছ লাগানাের ব্যবস্থা করেন এবং তাদের বিশ্রামের জন্য কিছু দূরত্ব অনুযায়ী সরাইখানা নির্মাণ করেন ।
( iii ) শেরশাহ ঘােড়ার পিঠে চড়ে ডাক – চলাচল ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নত রুপ দেন ।
মূল্যায়ন
( i ) ঐতিহাসিক ডব্লিউ কুক – এর মতে , শেরশাহ মূলত জনগণের ইচ্ছার ওপর তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তােলেন । ঐতিহাসিক কীন মনে করেন , ব্রিটিশের থেকেও শেরশাহের শাসন – প্রতিভা উজ্জ্বল ছিল ।
( ii ) অনেকে শেরশাহের কৃতিত্বকে মােগল সম্রাট আকবরের সমতুল্য বলে অভিহিত করেন । এ কথা সর্বাংশে সমর্থনযােগ্য নয় । আকবরের মতাে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা আদর্শভিত্তিক উদারতা শেরশাহের ছিল । তথাপি তাঁকে ‘ মধ্যযুগে ভারতের অন্যতম মহান শাসক ’ বলে অভিহিত করা যায় । অধ্যাপক জে. এন. চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন , জনগণের প্রতি ভালােবাসা ও সহানুভূতি , কৃষকদের প্রতি যত্ন , উদার দৃষ্টিভঙ্গি , নিরপেক্ষ বিচারবােধ , অক্লান্ত পরিশ্রম , কর্তব্য নিষ্ঠা এবং গঠনমূলক রাষ্ট্রপ্রজ্ঞা প্রভৃতির বিচারে শেরশাহকে আকবরের ঠিক পরেই স্থান দেওয়া উচিত ।