মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি আলােচনা করাে
Contents
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি আলােচনা করাে

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর ( ১৭০৭ খ্রি. ) সঙ্গে সঙ্গে মােগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় । পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বিশাল সাম্রাজ্য ক্ষয় পেতে পেতে কেবল দিল্লি ও আগ্রার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে । এর পরেও দীর্ঘকাল মােগল সম্রাটদের অস্তিত্ব ছিল । কিন্তু তা কেবল নামে মাত্র । ভারতের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনাে ক্ষমতাই তাঁদের ছিল না । নানা কারণে এই সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন ঘটেছিল ।
জায়গিরদারি সংকট
মােগল সাম্রাজ্যের পক্ষে অভিশাপস্বরূপ ছিল জায়গির – প্রথা । মােগল যুগে কর্মচারীদের নগদ বেতনের পরিবর্তে জমি ‘ জায়গির ’ হিসেবে দেওয়া হত । জায়গির ব্যবস্থা ক্রমশ ত্রুটিপূর্ণ হয়ে সাম্রাজ্যের ভিতে আঘাত করে । মনসবদারের সংখ্যার অনুপাতে জায়গির – জমি ছিল না । ফলে বিপত্তি দেখা দেয় । নির্ধারিত রাজস্ব ( জমা ) ও আদায়িকৃত রাজস্বের ( হাসিল ) মধ্যে বিরাট ফারাক থাকে । এইভাবে উদ্ভব হয় ‘ জায়গিরদারি সংকট ’।
কৃষি সংকট
বহু জায়গিরদার নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তাঁদের জায়গির একশ্রেণির লােকের হাতে তুলে দেন । এই লােকেদের বলা হয় ইজারাদার । ইজারাদারও মাত্রাহীন শােষণ দ্বারা কৃষকদের বেশি রাজস্ব দিতে বাধ্য করত । ইজারাদারের চাপে বাধ্য হয়ে বহু কৃষক জমি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেত । অনেকে মরিয়া হয়ে বিদ্রোহী হত । এইভাবে উদ্ভব হয় ‘ কৃষি – সংকটের ’ । এর ফলে ত্বরান্বিত হয় মােগল সাম্রাজ্যের পতন ।
দরবারের গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব
মােগল দরবারের অভিজাতরা ইরানি , তুরানি ও হিন্দুস্থানি — এই তিনটি গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল । মূলত সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ভালাে জায়গির লাভ ও প্রশাসনে কর্তৃত্ব করাই ছিল গােষ্ঠীগুলির লক্ষ্য । ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী দুর্বল শাসকদের আমলে অভিজাতদের গােষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্রতর হলে প্রশাসন দক্ষতাচ্যুত হয় । ফলে মােগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয় ।
ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতি
কেউ কেউ মনে করেন যে , ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতি মােগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন ত্বরান্বিত করেছিল । রাজত্বের অধিকাংশ সময় যুদ্ধে লিপ্ত থেকে তিনি দেশের অর্থ , উদ্যম ও শক্তি ক্ষয় করেন । রাজপুতদের মিত্রতা নষ্ট করে তিনি মােগল সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে তােলেন । দীর্ঘদিন দাক্ষিণাত্য – যুদ্ধে লিপ্ত থেকে একই সঙ্গে নিজের ও সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনেন । সর্বোপরি , নানা ধর্মের দেশ ভারতবর্ষে শাসন পরিচালনার জন্য যে উদারতার প্রয়ােজন , ঔরঙ্গজেবের মধ্যে তার অভাব ছিল । সংকীর্ণ ধর্মনীতিকে সমর্থন করে তিনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে মােগলের প্রতি বিরূপ করে তােলেন ।
কৃষক অসন্তোষ
কৃষি – সংকট থেকে কৃষকদের ওপর যে অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয় , তার পরিণামে কৃষকরা মরিয়া হয়ে বিদ্রোহে লিপ্ত হয় । আর্থিক দুর্দশা ও ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জাঠ , সৎনামী ও শিখ কৃষকেরা বিদ্রোহে লিপ্ত হন । একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ মােগল সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে ।
উত্তরাধিকার আইনের অভাব
মােগল রাজবংশে কোনাে সুনির্দিষ্ট উত্তরাধিকার আইন ছিল না । তাই সিংহাসন দখলের জন্য মােগল রাজপরিবারের মধ্যে প্রায়শই গৃহযুদ্ধ বাধত । ঔরঙ্গজেবের আমল থেকে মােগলদের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয় । এই সুযােগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে প্রয়াসী হয় । ফলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় ভাঙন ও দুর্বলতা প্রকট হয় ।
অর্থনৈতিক সংকট
মােগল রাজকোশে আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব ও বাণিজ্য কর । কিন্তু দরবারের জাঁকজমক , রাজপরিবার ও অভিজাতদের বিলাসব্যসন , হারেমের ব্যয়বাহুল্য ইত্যাদি রাজকোশের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে । সাধারণ মানুষের করভার বৃদ্ধি করে এই সংকট কাটানাের চেষ্টা করা হলে জনগণ ক্ষুদ্ধ হয় । ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে বিপুল অর্থ ব্যয় করলে সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত ভেঙে পড়ে এবং সংকট ঘনীভূত হয় ।
স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার ত্রুটি
মােগল শাসনব্যবস্থা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক । স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসকের ব্যক্তিত্ব , দক্ষতা , দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের মৌল উপাদান হিসেবে কাজ করে । কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী শাসকরা অধিকাংশই ছিলেন ব্যক্তিত্বহীন , হঠকারী ও কুচক্রী । ফলে তাঁরা কেন্দ্রীয় শাসনের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারেননি । সেই সুযােগে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি সক্রিয় হয়ে সাম্রাজ্যের পতন ডেকে আনে ।
আঞ্চলিক শক্তির উদ্ভব
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযােগে মােগল সাম্রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলি আঞ্চলিক ও প্রায় – স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে । নিজাম – উল – মুল্ক হায়দ্রাবাদে স্বাধীন রাজ্য গড়ে তােলেন । অযোধ্যায় সাদাত খাঁ , বাংলায় মুরশিদকুলি খাঁ স্বাধীনভাবে শাসনব্যবস্থা চালাতে থাকেন । মুখে সম্রাটের আনুগত্য মেনে নিলেও , তাঁদের স্বাধীন আচরণ বিচ্ছিন্নতাবাদকে মদত দেয় ।
বৈদেশিক আক্রমণ
অভ্যন্তরীণ সংকটে জীর্ণ মােগল সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি নাদির শাহের আক্রমণে কেঁপে ওঠে । নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে ( ১৭৩৯ খ্রি. ) বিপুল ধনসম্পদ লুঠ করে নিয়ে যান । তাঁর বাহিনীর অত্যাচারে নিহত হন অসংখ্য ভারতবাসী ।
অন্যান্য কারণ
সাম্রাজ্যের বিশালতা , দক্ষ নৌবাহিনীর অভাব , যােগাযােগ ব্যবস্থার দুর্বলতা ইত্যাদি আরও কিছু ত্রুটির সমন্বয়ে মােগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন অনিবার্য হয় । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাগজে কলমে মােগল সম্রাটের অস্তিত্ব টিকে ছিল । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে বন্দি ও রেঙ্গনে নির্বাসিত করলে আনুষ্ঠানিকভাবে মােগল শাসনের অবসান ঘটে ।