ইতিহাস

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

Contents

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্বে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে বৃহৎ গুপ্ত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল , মাত্র এক শতক পরেই তা পতনের পথে ধাবিত হয় । কোনাে সাম্রাজ্যের উত্থান যেমন আকস্মিক বা একদিনে হয় না , তেমনি পতনও একদিনে বা একটিমাত্র কারণে ঘটে না । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পেছনেও তাই একাধিক কারণের সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায় ।

Gupta Empire
গুপ্ত সাম্রাজ্য

আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব

প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতাস্পৃহা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তােলে । গুপ্ত শাসনব্যবস্থা নীতিগতভাবে প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা বহুলাংশে মেনে নিয়েছিল । সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত কিছু রাজাকে নিয়মিত করদান ও আনুগত্যের বিনিময়ে হৃতরাজ্য ও ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে এই ধারার সূচনা করেছিলেন । অবশ্য তাঁর আমলে ওই ধরনের শাসকরা যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিলেন । কিন্তু পরবর্তী গুপ্তরাজদের দুর্বলতার সুযােগে সামন্তরাজার সংখ্যা ও প্রভাব – প্রতিপত্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল । এঁদের কেউ কেউ ‘ রাজা ’ উপাধিও নিয়েছিলেন । শেষ পর্যন্ত দুর্বল গুপ্তরাজদের আমলে অধিকাংশ সামন্তরাজা স্বাধীনতা ঘােষণা করলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ঐক্য বিনষ্ট হয় । বলভীর মৈত্রক , কনৌজের মৌখরী , থানেশ্বরের বর্ধন প্রভৃতি একে একে গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে ।

অযােগ্য উত্তরাধিকার

দুর্বল ও অযােগ্য উত্তরাধিকার গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল । যে – কোনাে শাসনব্যবস্থায় রাজার যােগ্যতা , ব্যক্তিত্ব , দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি রাজ্যের উন্নতি ও সংহতির প্রধান শর্ত । স্কন্দগুপ্তকে এই বংশের শেষ শক্তিশালী সম্রাট বলে অভিহিত করা যেতে পারে । পরবর্তী শাসকেরা ছিলেন দুর্বল যােদ্ধা বা শাসক — কোনাে ভূমিকাতেই তাঁরা দক্ষ ছিলেন না । ফলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যেমন প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেয় , তেমনি বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে ।

ত্রুটিপূর্ণ ভূমিদান ব্যবস্থা

ত্রুটিপূর্ণ ভূমিদান ব্যবস্থা গুপ্ত বংশের দুর্বলতাকে ঘনীভূত করে । মৌর্য যুগে দান করা ভূমির নীচে অবস্থিত খনিজ পদার্থে রাজার অধিকার বজায় থাকত । একইভাবে দান করা গ্রামের প্রশাসনিক কর্তৃত্বও রাজার হাতে থাকত । কিন্তু গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণ বা কোনাে সংস্থাকে ভূমিদান করলে , সেই ভূমির ওপর রাজার কোনােরকম দাবি থাকত না । এমনকি ওই ভূমির প্রশাসনিক কর্তৃত্বও দানগ্রহীতার উপর বর্তাত । এর ফলে গুপ্ত যুগে একশ্রেণির নতুন ভূম্যধিকারীর সৃষ্টি হয়েছিল , যারা কালক্রমে রাজার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে শুরু করেছিল ।

দুর্বল সেনাবাহিনী

গুপ্ত যুগে রাজাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে কোনাে সুগঠিত সেনাবাহিনী ছিল কি না তা জানা যায় না । এমনকি ‘ হরিষেণ প্রশস্তিতে ’ও গুপ্ত সৈন্যবাহিনীর কোনাে উল্লেখ নেই । তা ছাড়া

গুপ্ত যুগে সৈন্যদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের মান সম্পর্কেও সঠিক জানা যায় না । পুষ্যমিত্র বা হূণ – আক্রমণকারীদের ব্যবহৃত উন্নত অস্ত্রের মােকাবিলা করার মতাে অস্ত্র খুব সম্ভব গুপ্তদের ছিল না । সম্ভবত গুপ্ত রাজাদের সেনাবাহিনীর জন্য সামন্তরাজাদের ওপর নির্ভর করতে হত । এই ধরনের নির্ভরতা যে রাজ্যের শক্তির প্রমাণ বহন করে না , তা বলাই বাহুল্য ।

অভিজাতদের বিলাসব্যসন

বিলাসব্যসনের আধিক্য গুপ্ত রাজপুরুষদের বহুলাংশে কর্মবিমুখ ও শান্তিপ্রিয় করে তুলেছিল । ব্যাবসাবাণিজ্যের বৃদ্ধির ফলে মধ্য – গুপ্তযুগে অভিজাত ও সামন্তদের মধ্যে বিলাস বৈভব অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল । যে অভিজাতশ্রেণি অতীতে বিচক্ষণ মন্ত্রী বা সুদক্ষ যােদ্ধার জন্ম দিয়েছিল , তারাই পরবর্তীকালে বিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার ফলে দেশ ক্ষাত্রশক্তিহীন হতে শুরু করে ।

অহিংস নীতি

গুপ্ত রাজাদের অহিংস নীতির প্রতি আকর্ষণ ও বৌদ্ধধর্মমতের প্রতি অনুরাগ গুপ্ত শাসনকে প্রথমদিকের ‘ রক্ত ও লৌহ ’ নীতি থেকে সরিয়ে আনে । ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর  মতে , তথাগতগুপ্ত , নরসিংহগুপ্ত প্রমুখ গুপ্তরাজারা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অহিংসার অনুগামী হয়ে পড়েন । এঁরা বস্তুত নিষ্ক্রিয়তাকেই বরণ করে নেন । ফলে সামরিক শক্তি দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত সাম্রাজ্য তার মূলাধার হারিয়ে ফেলে ।

বংশানুক্রমিক কর্মচারী

গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীদের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল । কিন্তু কালক্রমে মন্ত্রী – পদ বংশানুক্রমিক হয়ে পড়েছিল । এমনকি বেশ কিছু উচ্চপদেও বংশানুক্রমিকতার প্রবণতা দেখা গেছে । বীরসেন , পৃথিবীসেন , চিরাত দত্ত প্রমুখের পরিবার থেকে ক্রমান্বয়ে উচ্চপদে নিয়ােগের প্রমাণ পাওয়া গেছে । এর ফলে একদিকে অযােগ্য ব্যক্তিত্বে প্রশাসন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে , অন্যদিকে ওইসব পরিবারের প্রভাব – প্রতিপত্তি দ্রুত বৃদ্ধি পায় । কেন্দ্রের সামান্য দুর্বলতার সুযােগে এরাই স্বাধীন রাজত্বের জন্য সচেষ্ট হয়েছে । প্রমাণ হিসেবে সৌরাষ্ট্রের মৈত্রবংশের উত্থানের কথা বলা যায় ।

হূণ আক্রমণ

ক্রমাগত হূণজাতির আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে তােলে । এই আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে রাজকোশে অর্থাভাব প্রকট আকার ধারণ করে । বহিরাক্রমণের সুযােগে সামন্তরাজারা কেন্দ্রীয় শক্তিকে অস্বীকার করতে শুরু করে । তবে কোনাে কোনাে পণ্ডিতের মতে হূণরা আক্রমণ করলেও দেশের অভ্যন্তরে তার বিশেষ প্রভাব ছিল না ।

আর্থিক বিপর্যয়

অর্থনৈতিক বিপর্যয় ছিল এই সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ । চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে রােমের সাথে ভারতের বাণিজ্য প্রচণ্ডভাবে হ্রাস পায় । উপরন্তু রােমানরা চিন দেশ থেকে রেশম তৈরি শিখলে সেদেশে ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা অনেক কমে যায় । এইভাবে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে আগত অর্থের পথ বন্ধ হয়ে যায় । পরবর্তী গুপ্ত যুগে খাদমেশানাে মুদ্রা সে – যুগের আর্থিক অসচ্ছলতার প্রমাণ । এইভাবে একাধিক কারণের সমন্বয়ে একদা সমৃদ্ধ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ।

One thought on “গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

  • Anonymous

    দারুন

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!