ইতিহাস

বাংলায় পাল বংশের শাসনকাল

Contents

বাংলায় পাল বংশের শাসনকাল

1 15
পাল বংশের শাসন

গােপাল ( ৭৫০-৭৭০ খ্রি. )

দেশকে মাৎস‍্যন‍্যায় এর অরাজক অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা জনৈক সামন্ত গােপালকে মিলিতভাবে বাংলার সিংহাসনে বসান ( ৭৫০ খ্রি. ) । গােপাল ছিলেন দক্ষ বিচক্ষণ শাসক । তাঁর সিংহাসনে বসার ফলে বাংলায় নতুন যুগের সূচনা হয় । তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা । এ কাজে তিনি সফল হন । গােপালের নেতৃত্বে বাংলায় মাৎস্যন্যায় অবস্থার অবসান ঘটে । তিনি ‘ পরম সৌগত ’ উপাধি নিয়েছিলেন ।

ধর্মপাল ( ৭৭০-৮১০ খ্রি. )

পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গােপালের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ধর্মপাল ( ৭৭০ খ্রি. ) । তিনি ছিলেন সুদক্ষ যােদ্ধা ও কূটনীতিবিদ । ক্ষুদ্র পালরাজ্যকে তিনি সাম্রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত করেন । সেই সময় উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহারদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল । ধর্মপালও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়েন । এইভাবে শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী ‘ ত্রিশক্তি সংঘর্ষ ’। প্রতিহারদের আক্রমণে ধর্মপাল পরাজিত হন । তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিহাররাজ রাষ্ট্রকূটদের হাতে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান এবং রাষ্ট্রকূটরাজ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান । এই সুযােগে ধর্মপাল কনৌজের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন । কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে ধর্মপাল নিজ মনােনীত চক্ৰায়ুধকে বসিয়ে দেন । চক্ৰায়ুধের অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ভােজ , মৎস , কুরু , অবন্তী , মদ্র , গান্ধার , কীর , যবন , যুদ প্রভৃতি রাজ্যের সামন্তরাজারা ধর্মপালের সার্বভৌম আধিপত্য মেনে নেন ।

বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট প্রতিহার সিংহাসনে আরােহণ করলে আবার পাল – প্রতিহার সংঘর্ষ বাধে । নাগভট্ট প্রথমে চক্ৰায়ুধকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করেন । অতঃপর মুঙ্গেরের কাছে এক যুদ্ধে তিনি ধর্মপালকেও পরাজিত করেন । ঠিক এই সময় রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গােবিন্দ উত্তর ভারতে উপস্থিত হলে পরিস্থিতি পালটে যায় । দ্বিতীয় নাগভট্ট রাষ্ট্রকূটরাজের হাতে পরাজিত হয়ে স্বরাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন । ধর্মপাল ও চক্ৰায়ুধ বিনা যুদ্ধে তৃতীয় গােবিন্দের কাছে নতিস্বীকার করে তাঁর মিত্রতা লাভ করেন । অতঃপর রাষ্ট্রকুটরাজ দাক্ষিণাত্যে চলে গেলে ধর্মপাল উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব ফিরে পান । সােডঢল প্রণীত ‘ উদয়সুন্দরী কথা ’ কাব্যে ধর্মপালকে ‘ উত্তরপথস্বামী ’ বলা হয়েছে । এ থেকে অনুমান করা যায় যে , আর্যাবর্তের ওপর তাঁর অপ্রতিহত কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল ।

শিল্প , সাহিত্য ও উদার ধর্মমতের পৃষ্ঠপােষকরূপে ধর্মপাল খ্যাত ছিলেন । তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুগামী । তবে অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাঁর কোনাে বিদ্বেষ ছিল না । তিনি ‘ বিক্রমশীল ’ উপাধি নিয়েছিলেন । এই কারণে মগধে ধর্মপাল নির্মিত বৌদ্ধমঠটি ‘ বিক্রমশীল বিহার ‘ নামে পরিচিত হয় । পাহাড়পুরে ‘ সােমপুরী বিহার ’ এবং বিহারে ‘ ওদন্তপুরী বিহার ’ ধর্মপালের অন্য দুটি অনন্য কীর্তি ।

দেবপাল ( ৮১০-৮৫০ খ্রি. )

ধর্মপালের মৃত্যুর পর ( ৮১০ খ্রি. ) বাংলার সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র দেবপাল । দেবপাল ছিলেন পাল বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি । তিনি কেবল পিতার রাজ্যকে অক্ষুন্ন রাখেননি , প্রায় সমগ্র আর্যাবর্তের ওপর তাকে প্রসারিত করেন । প্রথমে তিনি উৎকল দেশ আক্রমণ ও জয় করেন । আসামের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসামকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেন । দেবপাল প্রতিহার ও রাষ্ট্রকুটদের প্রতিহত করে উত্তর ভারতে নিজ আধিপত্য অক্ষুন্ন রেখেছিলেন ।

দেবপাল বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন । দেশের বাইরেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল । সুমাত্রার রাজা বালপুত্রদেবের অনুরােধে দেবপাল নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণের অনুমতি দেন ও তাঁর ব্যয়নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রাম দান করেন । আরব পর্যটক সুলেমান দেবপালের সামরিক বাহিনীর শক্তি ও সামর্থ্যের প্রশংসা করেছেন । ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল মারা যান ।

প্রথম মহীপাল ( ৯৮৮-১০৩৮ খ্রি. )

দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যের দুর্দিন ঘনিয়ে আসে । পরবর্তী পাল রাজারা যথাক্রমে বিগ্রহপাল , নারায়ণপাল , রাজ্যপাল , দ্বিতীয় গােপাল প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্বল । ফলে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের শক্তির সামনে তাঁরা কোনােক্রমে অস্তিত্ব রক্ষা করে যান । দশম শতকের শেষ দিকে এই বংশের নবম রাজা প্রথম মহীপাল পাল বংশের লুপ্ত শক্তি ও গৌরব কিছুটা পুনরুদ্ধার করেন । তিনি প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ পুনরাধিকার করেন । বিহারও তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল । চোলরাজ রাজেন্দ্র চোল এই সময় বাংলা আক্রমণ করেন । তবে মহীপালের সাম্রাজ্যের কোনাে অংশ এতে হাতছাড়া হয়নি । অবশ্য কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব সম্ভবত মহীপালকে পরাজিত করে বারাণসী দখল করে নিয়েছিলেন ।

দ্বিতীয় মহীপাল ( ১০৭০-১০৭৫ খ্রি. )

প্রথম মহীপালের মৃত্যুর পর পালরাজ্য আবার দুর্বল হয়ে পড়ে । দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে দিব্য বা দিব্যোক – এর নেতৃত্বে কৈবর্তগণ বিদ্রোহ করে । সন্ধ্যাকর নন্দীররামচরিত কাব্য ’ – এ এই বিদ্রোহের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । দিব্য এই গণবিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । যাই হােক , বিদ্রোহীরা দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত ও হত্যা করে । অতঃপর বরেন্দ্রীতে ( উত্তরবঙ্গ ) কৈবর্তদের স্বাধীন শাসন শুরু হয় । দিব্যোকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রুদ্ৰোক ও তাঁর পুত্র ভীম বরেন্দ্রী শাসন করেন ।

রামপাল ( ১০৭৭-১১৩০ খ্রি. )

পাল সাম্রাজ্যের এই দুর্দিনের অবসান ঘটান রামপাল । তিনি ভীমকে পরাজিত করে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করেন । অতঃপর রামপাল আসাম ও বিহার – সহ বাংলার এক বৃহৎ অংশ নিজ অধিকারভুক্ত করেন । রামপালের কীর্তিকাহিনি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিত কাব্য থেকে সবিস্তারে জানা যায় । রামপাল ছিলেন পাল বংশের শেষ দক্ষ প্রতিনিধি । তাঁর মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য দ্রুত ভেঙে পড়ে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!